বিকাশ সাহাঃ গ্রাম বাংলার পূজা পার্বণে নদ নদী বিশেষ ভুমিকা পালন করে। সেই দিক দিয়ে উত্তর দিনাজপুর জেলার নদী গুলির গুরুত্ব অপরিসীম। উত্তর দিনাজপুর জেলার কালিয়াগঞ্জে শ্রীমতি নদীর তীরে বয়রা কালী পূজো শুরু হয়েছিল। বর্তমানে প্রায় সারা বছর ধরে শ্রীমতি নদীতে ধান চাষ হলেও এক সময় এই নদী খরস্রোতা ছিল। সেই সময় মন্দিরের পাশের গুদরী বাজার ঘাটে এসে বড়ো বড়ো নৌকা লাগত। নদী পথে যে সমস্ত বণিক সম্প্রদায় বাণিজ্য করতে আসতেন তাঁরা নদী তীরে একটি জঙ্গলে বয়রা গাছের তলায় কালী পূজোর সূচনা করেছিলো। সেই সময় থেকেই এই কালী “মা বয়রা কালী” নামে পরিচিতি লাভ করে। কথিত আছে, কালী পূজোর রাতে মা বয়রা কালিয়াগঞ্জ পরিক্রমায় বের হতেন। সেই সময় মা বয়রা কালীর নূপুরের আওয়াজ অনেকেই নিজে কানে শুনেছেন। এই বয়রা কালী মন্দির ঘেঁষে ১৯২৮ সালে কালিয়াগঞ্জ রেল লাইন স্থাপিত হয়। সেই রেল লাইন পথেই কালিয়াগঞ্জ হয়ে রায়গঞ্জ এসেছিলেন নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু। স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় বিপ্লবীরা কালিয়াগঞ্জের মজলিশপুরে মাঝে মধ্যেই আস্তানা গাড়তেন। সেই সঙ্গে বিপ্লবীরা শ্রীমতি নদী তীরের জঙ্গলাকীর্ণ এলাকায় নিয়মিত বৈঠক করতেন। ১৮৭৪ সালে কালিয়াগঞ্জের হাট কালিয়াগঞ্জে থানা স্থাপিত হয়েছিল। ইংরেজরা মজলিশপুর এলাকা সহ শ্রীমতি নদী তীর এলাকায় বিপ্লবীদের উপর নজরদারী চালানোর জন্য হাট কালিয়াগঞ্জ থেকে থানা স্থানান্তরিত হয় নদী তীর এলাকার কালিয়াগঞ্জে। সেই সময় কালিয়াগঞ্জ থানার দারোগা ছিলেন নজমূল হক। ইংরেজদের অধীনে চাকরী করলেও তিনি ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির যথেষ্ট মর্যাদা দিতেন। একজন খাঁটী মুসলিম হয়েও হিন্দু ধর্মের প্রতি ছিল তাঁর অগাত বিশ্বাস। দারোগা নজমূল হকের উদ্যোগ ও আপ্রাণ চেষ্টায় সেসময় তৈরি হয়েছিল মা বয়রার মন্দির। এই মন্দির তৈরির জন্য নজমূল বাবু এলাকার মানুষের কাছে গিয়ে অর্থ ভিক্ষা করে এবং কালিয়াগঞ্জ থানায় লবণের গাড়ি নিলাম করে সেই পয়সায় মন্দির তৈরি করেছিলেন। সেই সময় নিষ্ঠা ও আচারের মধ্য দিয়ে মা বয়রা কালী পূজোর আয়োজন তিনি নিজের উদ্যোগে করতেন। সাত দিন ধরে চলত গান বাজনার আসর। নজমূল হকের নামে মা বয়রা কালী মন্দিরের সামনে “নজমূ নাট্য নিকেতন” সম্প্রীতির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত আজও বর্তমান। দীর্ঘদিন বাদে কালিয়াগঞ্জের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী কনক প্রসাদ শিকদার পুরানো মন্দিরের স্থানেই নতুন মন্দির তৈরি করেন। ১৯৬৬ সালে দের লক্ষ টাকা ব্যায়ে মা বয়রার নতুন পাকা মন্দির তৈরি হয়। রায়গঞ্জ বালুরঘাট রাজ্য সড়কের পাশে অবস্থিত মা বয়রা কালীবাড়ি। ১৯৯৮ সালের ৬ ই এপ্রিল কালিয়াগঞ্জ বাসীর চেষ্টায় ও আর্থিক সহায়তায় মা বয়রার অষ্টধাতুর বিগ্রহ স্থাপন করা হয়। কৃষ্ণনগরের মৃগাঙ্ক পাল এই অষ্টধাতুর বিগ্রহটি তৈরি করেন। কালী পূজোর রাতে মা বয়রার গোটা শরীর সোনায় অলঙ্কারে ঢেকে যায়। পূজো শেষে পরের দিন সকালে মায়ের অলঙ্কার খুলে নিয়ে ব্যাঙ্কের লকারে রাখা হয়। কালী পূজোর রাত থেকে পরদিন সকাল পর্যন্ত কঠোর নিরাপত্তায় মুড়ে ফেলা হয় কালীবাড়ি চত্বর। প্রতি বছর পূজো শেষে পাঁঠা বলি হয়।
মা বয়রা কালী পূজো কমিটির প্রবীণ সদস্য অমলেশ লাহেড়ী (৭৯) যাকে মণ্টু লাহেড়ী বলেই সবাই চেনে, তিনি বলেন মা বয়রা কালীর আকর্ষণে শুধুমাত্র পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্ত থেকেই নয় ভারতবর্ষ সহ বিদেশ থেকেও ভক্তরা মা বয়রার পূজো দিতে আসেন। মায়ের মন্দিরে বছরের প্রতিদিন নিয়ম করে নিষ্ঠা, আচারের সঙ্গে পূজো হয়। প্রতি বছর ভক্তদের নানা ধরণের মানতে মায়ের পূজো মণ্ডপ যেন তীর্থক্ষেত্রের রূপ নেয়। তাই মা বয়রা কালী মন্দির জেলার গর্ব। বাড়ির বিভিন্ন পূজো, বাড়িতে না করে অনেক ভক্ত প্রাণ মানুষ মায়ের মন্দিরে এসে সেই পূজো দেওয়ার চল রয়েছে এখানে।
বণিক সম্প্রদায়ের দ্বারা কালিয়াগঞ্জে একটি বয়রা গাছের তলায় “মা বয়রা কালীর” পূজোর সূচনা
বৃহস্পতিবার,০৫/১১/২০১৫
729