বিকাশ সাহাঃ পৌষ সংক্রান্তি উপলক্ষে পৌষ পার্বণ উৎসবে মেতে উঠল গোটা উত্তর দিনাজপুর জেলা। পৌষ সংক্রান্তির আগের দিন বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই বাঙ্গালীর গৃহস্থ পড়িবার গুলির বাড়িঘর ধুয়ে মুছে পরিস্কার করে তোলা হয়েছে। গ্রাম্য পড়িবার গুলির উঠোনে গোবর লেপনের কাজও শেষ হয়েছে। দিনভোর মেঝে ও উঠানে নতুন চালের গুঁড়োর সঙ্গে জল গুলিয়ে আঁকানো হয় পুষনা পুষনীর ( স্থানীয় নাম) পড়িবারের আলপনা, সেই সঙ্গে গোলা ঘর, হাতা, করাই, মই সহ পড়িবারের ব্যবহারের যাবতীয় উপকরণ। সন্ধ্যে হতেই পরিমাণ মত সিদ্ধ বা আতপ চালের গুঁড়োতে জলে মিশিয়ে মাটির সরাতে মা-ঠাকুরমারা চিতই পিঠে বানাতে বসে গিয়েছেন। আতপ চালের গুঁড়োর চিতই পিঠে আলপনায় আঁকানো দেব দেবীর মুখে দিয়ে সরিষা ফুল সহ রকমারী ফুল দিয়ে পুজো সারেন মা-ঠাকুরমারা। বাড়ির গৃহ দেবতাকেও এদিন পিঠের ভোগ দেওয়া হয়। পিঠে টুকরো টুকরো করে পূর্ব পুরুষের উদ্দ্যেশ্য বাড়ির চারিদিকে ছুড়ে দেওয়া হয়। এরপরেই মাটির উনুনে অথবা গ্যাসের উপর মাটির সরাতে তৈরি করা হয় বিভিন্ন রকম পিঠে। অপরদিকে সংক্রান্তির দিন ভোর তিনটে থেকে মকরসংক্রান্তির পূর্ণস্নান সেরে পৌষ পার্বণের পুজোয় মেতে ওঠেন বাঙ্গালী পড়িবারের গৃহিণীরা। বৃহস্পতিবার রাতে পিঠেপুলি তৈরির পাশাপাশি এদিন শুক্রবার মকরসংক্রান্তির ভোরে বাড়ির তুলশি বেদীর সামনে গোল করে আতপ চালের গুঁড়ো ছিটিয়ে দিয়ে ৭ টি ফুল, ধান, দূর্বা দিয়ে উলুধ্বনি ও শঙ্খ বাজিয়ে পুজো করা হয়। গৃহদেবতাকে চিতই পিঠের ভোগ দেওয়া, পূর্বপুরুষের উদ্দেশ্যে চারিদিকে পিঠে ছড়ানো সহ কৃষক পড়িবারের লক্ষ্মী গরুকে পিঠে খাওয়ানো সবই চলে এদিন ভোরে কাকপক্ষী ডাকার আগে। এদিন দিনভর বানানো হয় বিভিন্ন সাধের পিঠে। যেমন, ঝাল পিঠে, পাটিসাপটা, পুলি, ভাপা পিঠে, চষি, দুধপুলি, চন্দ্রপুলি, মুগপুলি, মালপো, দুধ পিঠে সহ আরও হরেক রকম পিঠেপুলি।
গ্রাম বাংলার গৃহবধূরা চিতই পিঠে বা চিতি পিঠে বানাতে সিদ্ধহস্ত। চালের গুঁড়োর সাথে পরিমাণ মত জল মিশিয়ে বিভিন্ন সাঁচের মাটির মাত্রে দিয়ে গরম করলেই তৈরি হয়ে যায় চিতই পিঠে। মূলত এই পিঠে খাওয়া হয় চিনি বা খেজুর গুড় দিয়ে। এছারাও ঘন দুধের মধ্যে খেজুর গুড় সহ এই পিঠে ভিজিয়ে রেখে খাওয়ার প্রচলন রয়েছে। পিঠেপুলির দিন এত মিষ্টি জাতীয় খাবার খেতে খেতে একটু ঝাল জাতীয় খাবারের প্রতি রসনাতৃপ্ত বাঙ্গালীর মন চাইলে বাড়ির মা-ঠাকুরমারা বানিয়ে দেন ঝাল পিঠে। এটিও চিতই পিঠে। কিন্তু এই চিতই ঝাল পিঠের উপকরণে কুচিকুচি করে লঙ্কা ও হালকা হলুদ মিশিয়ে ঝাল পিঠে তৈরি করা হয়। চিতই পিঠে অতি সহজে, খুব কম সময়ে ও কম খরচে তৈরি করা সম্ভব। অন্যান্য পিঠের ক্ষেত্রে বেশি খরচ ও পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া থাকলেও চিতই পিঠের ক্ষেত্রে কোন পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া নেই, এমনটাই মত গৃহিণীদের।
পিঠেপুলি বানিয়ে একা খাবার চল কোনকালেই ছিল না বাঙ্গালীর। এক সময় ছিল যখন পৌষ পার্বণের দিনে গ্রাম বাংলায় এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়িতে পিঠেপুলি দেওয়া নেওয়ার চল ছিল। গ্রামের ছেলে ছোকরারা পালা করে পাড়ার বাড়ি বাড়ি ঘুরে পিঠে খেয়ে বেড়াত। যখন থেকে একান্নবর্তী পড়িবার ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হতে শুরু করেছে সেই সময় থেকেই বাঙ্গালীর এই পুরানো ঐতিহ্য ইতিহাসে পরিণত হয়েছে। তবে এখন সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটের দৌলতে বন্ধু বান্ধব, আত্মিয় স্বজনের উদ্দেশ্যে হরেকরকম পিঠেপুলির ছবি পোস্ট করে পৌষ পার্বণের দিনে বাঙ্গালীর পুরানো ঐতিহ্য গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ছে। তাতে পুরনো দিনের মত নিজের হাতে পিঠে বানিয়ে খাওয়ানোর আন্তরিকতা না থাকলেও রয়েছে সোশ্যাল নেটওয়ার্ক সাইটের বন্ধুদের পৌষ পার্বণ সম্পর্কে অবহিত করার হাতছানি।
পৌষ সংক্রান্তি উপলক্ষে পৌষ পার্বণ উৎসবে মেতে উঠল গোটা উত্তর দিনাজপুর জেলা
শুক্রবার,১৫/০১/২০১৬
1312