কিরীটেশ্বরী মন্দির হিন্দু ধর্মের পবিত্র তীর্থ পীঠগুলোর অন্যতম

লালবাগঃ কিরীটেশ্বরী মন্দির হল হিন্দু ধর্মের শাস্ত্র মতের পবিত্র তীর্থ পীঠগুলোর অন্যতম। মুর্শিদাবাদ জেলার নবগ্রাম থানার কিরীটেশ্বরী মৌজায় কিরীটেশ্বরী মন্দির সম্ভবত এই জেলার প্রাচীনতম মন্দির। দেবীর নাম অনুসারে গ্রামের নাম হয়েছে কিরীটেশ্বরী। তান্ত্রিকমতে এবং পীঠনির্ণয় ও পুরাণ কাহিনী অনুসারে এখানে দেবী দক্ষিয়ণী সতীর কিরীট অর্থাৎ মুকুটের কণা পতিত হয়েছিল। এইজন্য এই স্থানটিকে মহাপীঠ বলে। আবার এখানে দেবীর কোন অঙ্গ পতিত না হয়ে ভূষণ পতিত হয়েছিল তাই এই স্থানকে অনেকে তন্ত্রবিদ পূর্ণ পীঠস্থান না বলে উপপীঠও বলা হয়ে থাকে। এই পীঠে দেবী বিমলা এবং দেবীর ভৈরব সম্বর্ত নামে পুজিত হয়ে থাকেন।

লোকবিশ্বাস অনুসারে শক্তিপীঠ নামাঙ্কিত স্থানগুলিতে সতীর দেহের নানান অংশ ও অলংকার প্রস্তুরীভূত অবস্থায় রক্ষিত আছে। পীঠস্থানে পুজিতা দেবী দুর্গা বা পার্বতীর বিভিন্ন রুপ, ভৈরব অর্থাৎ ওই দেবীর স্বামী যারা প্রত্যেকেই শিবের বিভিন্ন রুপ। শাক্তমতে এই স্থান একটি প্রাচীন মহাপীঠ হিসেবে প্রসিদ্ধ। পাঠান-মুঘল শাসনকালেও এই স্থানের খ্যাতি ছিল। আঠার শতকের শেষে ফার্সি ভাষায় রচিত ঐতিহাসিক গ্রন্থ রিয়াজ-উস-সালাতিনে এবং রেনেলের কাশিমবাজার দ্বীপের মানচিত্রে তিরুথকোণা নাম পাওয়া যায়। তাছাড়া ভবিষ্যৎ পুরাণের ভৌগোলিক বিবরণ ব্রক্ষ্মান্ড অধ্যায়ে কিরীটকোণার উল্লেখ্য পাওয়া যায়।

১৪০৫ সালে আদি দক্ষিণমুখী মন্দিরটি তৈরি হয়েছিল বলে জানা যায়। আদি মন্দিরটি বর্তমানে লুপ্ত। গ্রামের দক্ষিণ অংশের কয়েক বিঘা জায়গা জুড়ে কিরীটেশ্বরী বর্তমান মন্দির এবং আরও কয়েকটি মন্দির অবস্থিত। আঠার শতকের প্রথম দিকে পশ্চিমমুখী বর্তমান মন্দিরটি নির্মাণ করান কানুনগো বঙ্গাধিকারী দর্পনারায়ণ রায়। মন্দিরের গর্ভগৃহে বিগ্রহ নেই, মন্দিরের ভিতরে একটি মর্মরবেদীর ওপর কালো পাথরের পীঠিকা। সম্ভবত তার উপর ছিল দেবীর কিরীট। বর্তমানে ওই কিরীট ( মতান্তরে কপালের হাড় ) গ্রামের একধারে ‘গুপ্তমঠ’ নামে একটি মন্দিরে লাল রেশমি কাপড়ে মুড়ে একটি কলসে রাখা আছে।

নাটোরের সাধন অনুরাগী রাজা রামকৃষ্ণ বড়নগর থেকে শক্তি সাধনার জন্য এখানে আসতেন। তিনি যে দুটি পাথরে বসে সাধনা করতেন সেই পাথর দুটি এখনও মন্দির প্রাঙ্গনের সামনে রাখা রয়েছে। হিন্দু দেওয়ানের পরামর্শে নবাব মীরজাফর আলি মৃত্যুকালে কিরীটেশ্বরী মায়ের চরণামৃত পানের ইচ্ছা প্রকাশ করেন বলেও শোনা যায়। জনশ্রুতি রয়েছে, বর্তমানে যে স্থানে গুপ্তমঠ রয়েছে প্রায় সাড়ে তিনশ বছর আগে ওই স্থানে ১৭২ ঘর পাণ্ডা এবং অন্যান্য জাতি-উপজাতির বসবাস ছিল। প্রায় ৩০০ বছর আগে আফগান আক্রমণের আশঙ্কায় পান্ডারা মূল পশ্চিমমুখী মন্দির থেকে দেবীকে বর্তমান গুপ্তমঠে নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু নিয়ে আসার সময় পাণ্ডারা মায়ের রুপ দেখার জন্য ইচ্ছা প্রকাশ করে সহমত হয়। প্রথমে জনা কয়েক পাণ্ডা মায়ের রুপ দেখেন। মায়ের রুপ দেখা মাত্রই মায়ের রুপ দর্শনকারী পাণ্ডারা অন্ধ হয়ে যান। এই ঘটনার পরেই অন্যান্য পাণ্ডারা মায়ের রুপ দর্শনে বিরত থাকেন। কিন্তু মায়ের রোষানলে পড়ে ১৭২ ঘর পান্ডা পরিবার বিনাশ হয়ে যায়।

গুপ্তমঠে প্রতিদিন সকালে দেবীর নিত্যপুজো হয়। দুপুরে ভাজা, তরকারী ও মৎস্য সহযোগে অন্নভোগ হয়। মন্দিরের পুরোহিত নেপাল ভট্টাচার্য বলেন, ৩৬৫ দিন দেবীর অন্নভোগে মাছ দিতে হয়। মাছ ছাড়া দেবীর ভোগ হয় না। দেবীর ভোগের মাছ ভক্তরা যোগান দেয়। প্রতিদিন কেউ না কেউ ভোগের আগে মন্দিরে মাছ দিয়ে যায়।

কালীপুজো দিন সারা রাত ধরে মায়ের পুজো হয়। পুজো শেষে ছাগ বলি দেওয়া হয় এখানে। এছাড়াও দূর্গা পুজোর অষ্টমীর পুণ্য তিথিতে গুপ্তমঠে মায়ের মহাপুজো হয়। মহাপুজো উপলক্ষ্যে মন্দিরকে রং করার পাশাপাশি আলো দিয়ে সাজিয়ে তোলা হয়। ওইদিন বহু মানুষ মানতের পুজো দিতে আসেন। মহাপুজোর দিন সকালে প্রথমে মায়ের মহাস্নান হয়। এরপরে দিনভর চলে যাগযজ্ঞ। যজ্ঞ শেষে মানতের ছাগ বলিদান দেওয়া হয়। মহাপুজো দেখতে কয়েক হাজার মানুষের সমাগম হয় গুপ্তমঠ প্রাঙ্গনে। মন্দিরে উপস্থিত সকলকেই মায়ের মহাপুজোর প্রসাদ দেওয়া হয়।

কিরীটেশ্বরী মহাপীঠ না উপপীঠ এই নিয়ে ভিন্ন মত থাকলেও কিরীটেশ্বরী হিন্দুদের কাছে একটি পবিত্র তীর্থস্থান এই বিষয় নিয়ে কোন দ্বিমত নেই। পাশের জেলা বীরভূমের তারাপীঠে তারা মায়ের দর্শনে হাজার হাজার মানুষের সমাগম হয়। কিন্তু সঠিক প্রচারের অভাবে কিরীটেশ্বরীতে সেইভাবে লোকের সমাগম হয় না। তবে পৌষ মাসের প্রতি মঙ্গলবার মূল মন্দিরের সামনের মাঠে মেলা বসে। পৌষ মাসে কিরীটেশ্বরীর মেলা দেখতে মুর্শিদাবাদ সহ পাশের জেলা মালদা, নদীয়া ও বীরভূম থেকেও প্রচুর মানুষের সমাগম হয়।

Susmita Sarkar

Share
Published by
Susmita Sarkar

Recent Posts

সিএএ নিয়ে প্রচারে মনোরঞ্জন, সাবধান করছেন এলাকার

২৪ এর লোকসভা ভোটে রাজ্যে অন্যতম ইস্যু হয়ে উঠেছে সিএএ। বিজেপির পক্ষ থেকে এই নিয়ে…

2 days ago

সন্দেশখালির ঘটনা সাজানো, বিজেপির পরিকল্পিত চিত্রনাট্য, ভাইরাল ভিডিয়োই দাবি বিজেপি নেতার

সন্দেশখালির ঘটনা নিয়ে এবার নয়া মোড়। সন্দেশখালি আন্দোলন থেকে শুরু করে যা যা ঘটেছে সম্পূর্ণটাই…

2 days ago

“আহা কী আনন্দ আকাশে বাতাসে”- কুনাল ঘোষের গলায় কেন এই গান?

বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিলেন। বেশ কিছুদিন ধরে বেশ কিছু বিষয় নিয়ে দলবিরোধী কথা বলছিলেন। বিশেষ করে…

2 days ago

“সনাতন বিরোধী তৃণমূল”- দৈনিক সংবাদপত্রে বিজেপির বিজ্ঞাপন , প্রচারে ‘ধর্ম’ ব্যবহার করায় কমিশনে তৃণমূল

বিজেপির বিজ্ঞাপনে 'ধর্ম' হাতিয়ার, নির্বাচন কমিশনের নজরে আনল তৃণমূল কংগ্রেস। যেখানে নির্বাচন কমিশনের নির্দেশিকায় স্পষ্ট…

2 days ago

বিগত বছরে বিদ্যুতের মাশুল বৃদ্ধি হয় নি, দাবি WBSEDCL এর

বিদ্যুতের মাশুল বৃদ্ধি হয়েছে বলে মিথ্যে রটনা শুরু হয়েছে। বিগত বছরে এমন কোন মাশুল বৃদ্ধি…

2 days ago

হেলিকপ্টারে আগুনের ঘটনায় থমকে নেই দেব, শনিবার দলীয় প্রার্থীদের সমর্থনে চুটিয়ে প্রচার

হেলিকপ্টারে হঠাৎ আগুন। বড় বিপদের হাত থেকে রক্ষা পান অভিনেতা তথা তৃণমূল প্রার্থী দেব। তবে…

2 days ago
https://www.banglaexpress.in/ Ocean code: