ডেস্ক রিপোর্ট, ঢাকা: ২০১৯ পুরোটা সময়ই বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে অর্থনীতিবিদ, গবেষক, রাজনীতিবিদসহ বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষ ব্যাপক আলোচনা, পর্যালোচনা ও সমালোচনায় মুখর ছিল। পুঁজিবাজারের অস্থিরতা, বৈদেশিক ঋণ ও অনুদান হ্রাস, শিল্প খাতে পুঁজি প্রবাহ হ্রাস, তারল্য সংকট, মূল্যস্ফীতি, নিত্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধি, বেকারত্বসহ নানাবিধ কারণে অর্থনীতিতে নেমেছে স্থবিরতা আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা পর বর্ষবরণের আবাহন রেখে কুয়াশামোড়া পান্ডুর সূর্য আজ বিদায় নেবে মহাকালের যাত্রায়। জীর্ণ ঝরা পলস্নবের মতো সরল রৈখিক গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের পাতা থেকে আজ খসে পড়বে ‘২০১৯‘। মধ্যরাতে নতুন বছর ২০২০–কে স্বাগত জানানোর উৎসবের বাঁশি বেজে উঠবে সবার প্রাণে। ভোরে পুব আকাশে আলো ছড়াবে ২০২০ এর নতুন সূর্য। আগামীকাল থেকে শুরু হবে নতুন প্রত্যাশার নতুন বছর। তবে যে বছরটি হারিয়ে গেল জীবন থেকে, ক্যালেন্ডারের পাতা থেকে, তার সবই কি হারিয়ে যাবে? মুছে যাবে সব? ঘটনাবহুল ২০১৯–এর অনেক ঘটনার রেশ টেনেই মানুষ এগিয়ে যাবে ২০২০ সালের দিনরাত্রির পথে। প্রাপ্তি–অপ্রাপ্তির নিরিখে পেছনে তাকালে দেখা যাবে প্রাপ্তির উজ্জ্বল কিছু সোনালি শস্য; অন্যদিকে অতৃপ্তির কিছু শীর্ণপাতার মতো রিক্ততারও আর্তি জেগে আছে। ২
০১৯ পুরোটা সময়ই বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে অর্থনীতিবিদ, গবেষক, রাজনীতিবিদসহ বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষ ব্যাপক আলোচনা, পর্যালোচনা ও সমালোচনায় মুখর ছিল। নানাবিধ সংকটের মাঝে কঠিন দুঃসময় পার করেছে দেশের অর্থনীতি। পুঁজিবাজারের অস্থিরতা, বৈদেশিক ঋণ ও অনুদান হ্রাস, শিল্প খাতে পুঁজি প্রবাহ হ্রাস, তারল্য সংকট, মূল্যস্ফীতি, নিত্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধি, বেকারত্বসহ নানাবিধ কারণে অর্থনীতিতে নেমেছে স্থবিরতা। পুরো বছরটি জুড়ে বাংলাদেশে সংবাদমাধ্যমে রাজনৈতিক দুর্নীতি, অপরাধ বা দুর্ঘটনার মতো নেতিবাচক খবরেরই ছিল প্রাধান্য। আর বছরের শেষভাগে পেঁয়াজের আকাশছোঁয়া দর সাধারণ মানুষের নাক–মুখের জল এক করে আলোচিত চরিত্র হয়ে উঠেছে। এ নিয়ে সাধারণা মানুষের মাঝে তীব্র ক্ষোভ ও অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে। এমনকি মামুল এ রন্ধন উপাদানের অগ্নিমূল্যের কারণে ক্ষমতাসীন দলের মন্ত্রী–আমলা, সরকারকেও চরম নাজেহাল হতে হয়েছে। এদিকে পেঁয়াজ নিয়ে শুধু আলোচনা কিংবা সমালোচনাই হয়নি, এ নিয়ে রম্য রচনাও রচিত হয়েছে। পেঁয়াজের দাম কেন এত বাড়ল? দেশে কি পেঁয়াজ নেই? গত বছরগুলোর তুলনায় পেঁয়াজ উৎপাদন কমেছে, নাকি পেঁয়াজ সব দেশের বাইরে চলে গেছে? –বিভিন্ন মহলে এমন হাজারো প্রশ্ন উঠেছে। যদিও এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর কারও কাছ থেকেই মেলেনি। যা সাধারণ মানুষকে ভীষণভাবে হতাশ করেছে। অন্যদিকে সংকটকালীন বিভিন্ন দেশ থেকে পেঁয়াজের চালান আসার খবর খোদ মন্ত্রী আমলারা প্রচার করলেও এর দাম না কমে বরং সেঞ্চুরি থেকে ডাবল সেঞ্চুরির কোটা পার হওয়ায় এসব খবরের সত্যতা নিয়ে নানা মহলে সমালোচনার ঝড় উঠেছে।
অথচ একই সময় বিভিন্ন মিডিয়ায় গুদামে মজুদ রাখা পেঁয়াজে গাছ গজানো এবং পচা পেঁয়াজ ফেলে দেওয়ার খবর প্রকাশিত হয়েছে। পেঁয়াজ নিয়ে ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে টানা আড়াই মাসেরও বেশি সময় নানা ধরনের ট্রল, রম্য রচনা, কৌতুক, ভাবনা ও উপাখ্যানও কম হয়নি। বিভিন্ন স্থানে বিয়েতে নামিদামি উপহার না দিয়ে পেঁয়াজ উপহার দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। পেঁয়াজের দাম বেড়ে নায়ক বনে যাওয়ার সুযোগে দেশের মানুষ বিশাল আকারের গোল পেঁয়াজ, গাছে ধরা পেঁয়াজ ও সাদা পেঁয়াজসহ নানা ধরনের পেঁয়াজের রূপ দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। বাজারে পেঁয়াজ হালি দরে বিক্রির চিত্র ছিল এবারই প্রথম। সেপ্টেম্বর থেকে ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ রাখার পর থেকে সরকার বেশ কিছু উদ্যোগের কথা বললেও এর দাম না কমার রহস্য খুঁজতে গিয়ে বাজার পর্যবেক্ষকরা বেশকিছু অসঙ্গতির সন্ধান পেয়েছেন। সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, পেঁয়াজের চাহিদার ৬০ শতাংশ মেটানো হয় দেশে উৎপাদিত পেঁয়াজ থেকে। বাকি পেঁয়াজ আমদানি করা হয়। যার সিংহভাগই আসে ভারত থেকে। অথচ সংকটকালীন ভারত নানা অযুহাতে বাংলাদেশে পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছে। অথচ ভারতকেন্দ্রিক আমদানিকারকরা অন্য কোনো দেশ থেকে পেঁয়াজ আনার ঝুঁকি নিতে চাননি। যা পেঁয়াজদের দর লাগামহীন করে তুলতে সহায়ক হয়েছে। যদিও পরবর্তীতে মিশর, পাকিস্তান, চীন, মিয়ানমার, তুরস্কসহ বেশ কটি দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে তা উপযুক্ত সময়ে না হওয়ায় এর ইতিবাচক প্রভাব সেভাবে বাজারে পড়েনি। পেঁয়াজ আমদানিকারকরা ভিন্ন দেশ থেকে পেঁয়াজ আনতে দ্রম্নত পদক্ষেপ না নেওয়ার কারণ হিসেবে জানিয়েছেন, ভারত থেকে পেঁয়াজ আনতে কেজিপ্রতি দুই থেকে আড়াই টাকা পরিবহন খরচ হয়। অথচ মিশর থেকে পেঁয়াজ আনতে কেজিপ্রতি পরিবহণ খরচ কখনো ২০ টাকা ছাড়িয়ে যায়।
এছাড়া অন্য দেশ থেকে আনতে গেলেও পরিবহণ খরচ বাড়তির দিকেই থাকে। এ কারণে কেউ দ্রম্নত অন্য দেশ থেকে পেঁয়াজ আনতে উদ্যোগ নেয়নি। অন্যদিকে ভারত বাদ দিয়ে নতুন করে ভিন্ন দেশ থেকে পেঁয়াজ রপ্তানির জন্য এলসি খোলা, সেখানকার ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যোগাযোগ করাসহ অন্যান্য প্রক্রিয়াতেও যথেষ্ট সময় লেগেছে। যা ঊর্ধ্বমুখী বাজারকে আরও উত্তপ্ত করে তুলেছে। এছাড়া মুনাফা লোভী সিন্ডিকেটের বাজার নিয়ন্ত্রণের নানা অপকৌশল পেঁয়াজের বাজারকে লাগামহীন করে তুলে সাধারণ মানুষকে ভীষণভাবে ভুগিয়েছে। মিশর ও পাকিস্তানসহ বেশকিছু দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানির পর দেশে এর পর্যাপ্ত মজুদ গড়ে উঠলেও ওই সিন্ডিকেট তা বাজারে যথাযথভাবে সরবরাহ না করে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করেছে। ব্যক্তি উদ্যোগে পেঁয়াজ আমদানির পাশাপাশি সরকারিভাবে এ পেঁয়াজ আমদানি করা হলে আমদানিকারকদের পক্ষে সিন্ডিকেট গড়ে তোলা সম্ভব হতো না বলে মনে করেন বাজার সংশ্লিষ্টরা। এদিকে পেঁয়াজের দরের উর্ধ্বগতির প্রথমভাগে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে সতর্ক না হলেও এ নিয়ে হ–য–ব–র–ল পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার পর খোদ কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক যথাসময়ে পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারের দুর্বলতার কথা স্বীকার করেন। এ সময় তিনি বলেন, ‘গত বছর আমাদের আগেই বৃষ্টি শুরু হয়েছিল। মাঠে অনেক পেঁয়াজ ছিল। পেঁয়াজ সহজেই পচনশীল একটি ফসল। অনেক পেঁয়াজের ক্ষতি হয়েছে। যার জন্য আমাদের ঘাটতি ছিল। আমাদের একটি দুর্বল দিক হলো আমাদের আগেই ‘অ্যাসেস‘ করা উচিত ছিল যে এবার আমাদের পেঁয়াজের ঘাটতি হবে। যা আমরা করতে পারিনি।‘ তিনি আরও বলেন, ‘স্থানীয় যে উৎপাদন হয়েছে সেটি যথেষ্ট নয়।
কিন্তু সবচেয়ে সমস্যা করেছে ভারত। তাদের কোনো সমস্যা নাই, তারপরও তারা কেন রপ্তানিতে ব্যান দিলো আমি জানি না।‘ তবে কৃষি বিশেষজ্ঞ অনেকের অভিযোগ, সরকারের তরফ থেকে পেঁয়াজ নিয়ে কখনো খুব গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। পেঁয়াজ চাষাবাদের জমি আগের তুলনায় বাড়ার ফলে গড় হিসাবে উৎপাদন বেড়েছে ঠিকই, কিন্তু হেক্টরপ্রতি উৎপাদন আগের চেয়ে কমেছে। ফলে কৃষকরা নিরুৎসাহ হচ্ছেন পেঁয়াজ চাষাবাদে। অথচ কৃষকদের এ ব্যাপারে উৎসাহিত করতে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। কৃষি মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদন ২০১৮–১৯ অনুসারে দেশে পেঁয়াজ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ২৩ লাখ ৭৬ হাজার টন, সেখানে উৎপাদন হয়েছে ২৩ লাখ ৩০ হাজার টন। আবার একই মন্ত্রণালয়ের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের গত ২০ অক্টোবরের আরেক তথ্যে অনুসারে দেখা যায়, ২০১৮–১৯ বছরে দেশে মোট এক লাখ ছয় হাজার হেক্টর জমিতে ২০ লাখ ১৮ হাজার টন পেঁয়াজ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু কৃষকরা পেঁয়াজ উৎপাদন করেন আরও বেশি, ২ দশমিক ২ লাখ হেক্টর জমিতে। এতে উৎপাদন হয়েছে ২৩ লাখ ৮১ হাজার টন। তবে হেক্টরপ্রতি উৎপাদন কম হয়েছে। প্রতি হেক্টরে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১২ টনের, কিন্তু উৎপাদন হয়েছে ১১ দশমিক ২৮ টন করে।
একই অধিদপ্তরের আরেকটি বার্ষিক প্রতিবেদনে উলেস্নখ করা হয়েছে, ২০১৮–১৯ বছরে পেঁয়াজ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২৩ লাখ ৭৬ হাজার টন আর উৎপাদন হয়েছে ২৬ লাখ ২০ হাজার টন। কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্যেই এমন গড়বড় দেখা যায় তাদের নথিপত্র থেকে। তবে ওই এক বছরই নয়, আগের আরও কয়েক বছরের তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, ২০১৩–১৪ অর্থবছরেও এক লাখ ৮৬ হাজার হেক্টর জমিতে ১৪ লাখ ৮৮ হাজার টন পেঁয়াজ চাষের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল, সেখানে উৎপাদন হয়েছিল এক লাখ ৮৭ হাজার হেক্টর জমিতে ১৭ লাখ টন পেঁয়াজ।