পূর্ব রেলওয়ের হাওড়া ডিভিশনের অন্তর্গত পূর্ব বর্ধমানের মহকুমা শহর কাটোয়ার ইতিহাস

অতিমারীর প্রাদুর্ভাবে গৃহবন্দী হয়ে পড়েছেন তো? অনেকদিন কোথাও বেড়াতে যাওয়া হয় নি। তাই না? মন খারাপ করার কোনো কারণ নেই , চলুন আজ আমরা আপনাদের নিয়ে যাই পূর্ব রেলওয়ের হাওড়া ডিভিশনের অন্তর্গত পূর্ব বর্ধমানের মহকুমা শহর কাটোয়ায়।ভাগীরথী নদী ও অজয় নদের সংগমস্থলে গড়ে ওঠা প্রাচীন ও ঐতিহাসিক জনপদ ইন্দ্রানী পরগনাই আজকের শহর কাটোয়া। জানা যায় কাটোয়া শহরের আদি নাম ছিল ইন্দ্রাণী পরগনা।পরবর্তী কালে এই নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় কন্টক নগরী। ১৮৫০ সালে স্থাপিত এই শহরটির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে ৫০০ বছরের পুরোনো ইতিহাস। তৎকালীন বাংলা সুবাহার রাজধানী , মুর্শিদাবাদের প্রবেশপথ ছিল কাটোয়া। সেইসময় বাংলার নবাব ছিলেন মুর্শিদকুলি খাঁন, তাঁর রাজত্বকালে কাটোয়াতে তিনি প্রথম একটি চৌকি প্রতিষ্ঠা করেন। ঐতিহাসিক পটভূমিতে দাঁড়িয়ে বেশকিছু রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের সাক্ষী থেকেছে এই শহর। বাংলার নবাব আলীবর্দী খাঁনের আমলে নাগপুরের মারাঠা রাজা প্রথম রঘুজি ভোঁসলের মারাঠা বর্গীরা এই অঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে লুটপাট চালাতে শুরু করে এবং কিছুদিনের মধ্যেই কাটোয়া শহরে নিজেদের ঘাঁটি তৈরি করে। সেই সময় মারাঠা বর্গীদের প্রধান ছিলেন ভাস্কর পন্ডিত। তাঁর হাত ধরেই এই শহরে দুর্গাপুজোর প্রচলন হয়। ১৭৪২ সালে এই দুর্গাপুজোর সময় বেজে ওঠে রণ দামামা, ভাস্কর পন্ডিত তখন ব্যস্ত পুজোর কাজে, সেই সময় কাটোয়া থেকে এক মাইল উত্তরে উদ্ধারনপুরের কাছে গঙ্গা পার হয়ে হঠাৎই মারাঠা বর্গীদের ওপর অতর্কিতে হামলা চালায় নবাব আলীবর্দী খাঁন ও তাঁর সেনা বাহিনী। কাটোয়ার প্রথম যুদ্ধে নবাবের কাছে হার স্বীকার করে মারাঠা বর্গীরা। তবে এই পরাজয়ের বদলা নিতেই ১৭৪৫ সালে আবার বাংলা আক্রমণ করে মারাঠারা। প্রথম যুদ্ধের ব্যার্থতার রেশ কাটতে না কাটতেই কাটোয়ার দ্বিতীয় যুদ্ধেও নবাব আলীবর্দী খাঁনের কাছে পরাজিত হয়ে বাংলা থেকে বিতাড়িত হতে হয় মারাঠাদের।

তবে এখানেই শেষ নয়, যে যুদ্ধের মাধ্যমে আমাদের দেশে ইংরেজ শাসনের পথ প্রশস্ত হয়, ১৭৫৭ সালের গুরুত্বপূর্ণ পলাশীর যুদ্ধের সাথে জড়িয়ে যায় কাটোয়া শহরের বাম। পলাশীর যুদ্ধে যাওয়ার পথে কাটোয়াতে সর্বশেষ নবাবী গ্যারিসন কে পরাজিত করেন রবার্ট ক্লাইভ ও তাঁর ইংরেজ বাহিনী। ১৭৬৩ সালে এই শহরেই ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ইংরেজ সেনাবাহিনীর কাছে যুদ্ধে পরাজিত হন তৎকালীন বাংলার নবাব মির কাশিম। ইতিহাসের পাতায় এই যুদ্ধ কাটোয়ার তৃতীয় যুদ্ধ হিসেবে উল্লেখিত।একদিকে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে গুরুত্বপূর্ণ স্থান হিসেবে যেমন উঠে আসে এই শহরের নাম, অন্যদিকে ঠিক তেমনই তীর্থক্ষেত্র হিসেবেও কাটোয়ার মাহাত্ম্য অনস্বীকার্য। কাটোয়ার নামের সাথে জড়িয়ে রয়েছে শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভুর নাম।১৫১০ সালে এই শহরেই গুরু কেশব ভারতীর কাছে দীক্ষা নেন মহাপ্রভু। তাঁর নাম হয় শ্রী চৈতন্য গিরি। সেই সময় থেকেই বৈষ্ণবদের তীর্থক্ষেত্র হয়ে ওঠে এই শহর। দীক্ষা গ্রহণের আগে মধু নাপিতের কাছে মস্তক মুন্ডন করেন মহাপ্রভু, পরে মধু নাপিতের সেই স্থানেই গড়ে ওঠে সখিরা আখড়া আশ্রম। জানা যায় নবদ্বীপ থেকে কাটোয়া আসার সময় একটি মাধবী গাছের নিচে বিশ্রাম নিয়েছিলেন মহাপ্রভু। সেই মাধবীকুঞ্জ এ প্রভুর বিশ্রামস্থল কে কেন্দ্র করে তাঁর দুই অন্যতম প্রিয় শিষ্য জগাই ও মাধাই একটি অশ্রম তৈরি করেন, যা আজ কাটোয়া শহরের বুকে মাধাইতলা আশ্রম হিসেবে স্বমহিমায় বিরাজমান।

মহাপ্রভু যে স্থানে দীক্ষিত হয়েছিলেন, বর্তমানে সেই স্থানের নাম গৌরাঙ্গবাড়ি। মহাপ্রভুর স্মৃতিবিজড়িত এই গৌরাঙ্গবাড়িকে কেন্দ্র করে সারা বছর ধরে প্রচুর বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বীদের সমাগম হয় এই শহরে।কণ্টক নগরী থেকে কাটোয়া শহর হয়ে ওঠার নেপথ্যে যে নামটি উঠে আসে , সে টি হলো উইলিয়াম কেরি। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীনে এবং বিখ্যাত ধর্ম প্রচারক উইলিয়াম কেরির পুত্র উইলিয়াম কেরি জুনিয়রের মতো ধর্ম প্রচারক দের অদম্য চেষ্টায় ধীরে ধীরে নগর থেকে শহর হয়ে ওঠে কাটোয়া । নদী তীরবর্তী শহর হওয়ায় নদী মাতৃক লবন বাণিজ্যের ওপর ভর করেই গড়ে ওঠে শহরটির অর্থনৈতিক পরিকাঠামো। অবশেষে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে সমৃদ্ধশালী শহর হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে কাটোয়া।বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিক থেকে কাটোয়া শহরের নগরায়নের পক্রিয়া আরো দ্রুততর চলতে শুরু করে রেলপথ নির্মাণের মাধ্যমে। কিভাবে শুরু হয়েছিল সেই জয়যাত্রা, রেলপথ কে কেন্দ্র করে কিভাবেই বা গড়ে উঠেছিল পর্যটন, জানতে ইচ্ছে করছে তো? সেই গল্প নিয়েই কাল ফিরে আসছি আপনাদের কাছে, সঙ্গে থাকুন, সুস্থ্য ও নিরাপদ থাকুন।

admin

Share
Published by
admin
  • https://www.banglaexpress.in/ Ocean code:

Recent Posts

সিএএ নিয়ে প্রচারে মনোরঞ্জন, সাবধান করছেন এলাকার

২৪ এর লোকসভা ভোটে রাজ্যে অন্যতম ইস্যু হয়ে উঠেছে সিএএ। বিজেপির পক্ষ থেকে এই নিয়ে…

1 week ago

সন্দেশখালির ঘটনা সাজানো, বিজেপির পরিকল্পিত চিত্রনাট্য, ভাইরাল ভিডিয়োই দাবি বিজেপি নেতার

সন্দেশখালির ঘটনা নিয়ে এবার নয়া মোড়। সন্দেশখালি আন্দোলন থেকে শুরু করে যা যা ঘটেছে সম্পূর্ণটাই…

1 week ago

“আহা কী আনন্দ আকাশে বাতাসে”- কুনাল ঘোষের গলায় কেন এই গান?

বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিলেন। বেশ কিছুদিন ধরে বেশ কিছু বিষয় নিয়ে দলবিরোধী কথা বলছিলেন। বিশেষ করে…

1 week ago

“সনাতন বিরোধী তৃণমূল”- দৈনিক সংবাদপত্রে বিজেপির বিজ্ঞাপন , প্রচারে ‘ধর্ম’ ব্যবহার করায় কমিশনে তৃণমূল

বিজেপির বিজ্ঞাপনে 'ধর্ম' হাতিয়ার, নির্বাচন কমিশনের নজরে আনল তৃণমূল কংগ্রেস। যেখানে নির্বাচন কমিশনের নির্দেশিকায় স্পষ্ট…

1 week ago

বিগত বছরে বিদ্যুতের মাশুল বৃদ্ধি হয় নি, দাবি WBSEDCL এর

বিদ্যুতের মাশুল বৃদ্ধি হয়েছে বলে মিথ্যে রটনা শুরু হয়েছে। বিগত বছরে এমন কোন মাশুল বৃদ্ধি…

1 week ago

হেলিকপ্টারে আগুনের ঘটনায় থমকে নেই দেব, শনিবার দলীয় প্রার্থীদের সমর্থনে চুটিয়ে প্রচার

হেলিকপ্টারে হঠাৎ আগুন। বড় বিপদের হাত থেকে রক্ষা পান অভিনেতা তথা তৃণমূল প্রার্থী দেব। তবে…

1 week ago
https://www.banglaexpress.in/ Ocean code: