আঁধার ঘরের প্রদীপ

আঁধার ঘরের প্রদীপ…..।।

অশোক মজুমদার: প্রদীপের নিচেই সবচেয়ে বেশি অন্ধকার। দিনরাত নামতা পড়ার মত গণতন্ত্র, মানবাধিকার, ন্যায়বিচার ইত্যাদি কথা আউরে চললেও তার কোনটারই অস্তিত্ব নেই নিউজপেপার ব্যারন সরকার বাবুদের পরিচালিত আনন্দবাজারে। বস্তুত এটা এক নিরানন্দ বাজার। মঙ্গলবারের আনন্দবাজারে আটপাতাতে কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলিতে সাংবাদিক খুন ও নিগ্রহের ব্যাপারে কমনওয়েলথ-এর প্রতিবাদ জানানোর খবর রয়েছে। কিন্তু যে কাগজ এ খবর ছাপছে সেখানে কিন্তু সাংবাদিক ও অসাংবাদিকদের অধিকার প্রতিনিয়ত লুণ্ঠিত হয়ে চলেছে। গত কয়েকবছর ধরেই সেখানে চলছে খেয়ালখুশিমত নির্বিচার কর্মী ছাঁটাই। ইতিমধ্যেই চারশোর বেশি সাংবাদিক ও অসাংবাদিক কর্মীর চাকরি গেছে। এদের মধ্যে কয়েকজনের চাকরি গেছে মাত্র কয়েক ঘন্টার নোটিশে। এমনকি সুবিধাবাদী ও চাটুকার সাংবাদিকেরাও রেহাই পাচ্ছেন না। দিদি এ ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়ে খুব সঠিকভাবেই বলেছেন ‘সাংবাদিকদের তোমরা ভাবো কেনা পুতুল, যাদের নিজেদের প্রতিষ্ঠানে কোন স্বাধীনতা নেই তারা আবার অন্যের স্বাধীনতা নিয়ে কথা বলে।’

আমি ভাবছিলাম, প্রদীপের নিচেই সবচেয়ে বেশি অন্ধকার। কয়েকদিন আগেই এই বাড়িরই কিছু চাটুকার সাংবাদিকদের দেখছিলাম সাংবাদিকদের অধিকার রক্ষার প্রতিবাদ মিছিলে। তারা কিন্তু এ ব্যাপারে কোন প্রশ্ন তোলেন না। অবাক হয়ে আমি দেখি, বিবেকবান বুদ্ধিজীবী ও ভালো মানুষ হিসেবে বর্ণিত যে অনির্বাণ দীপশিখা সরকার বাড়ির ঠাণ্ডা ঘরে জ্বলছেন তিনিও নীরব। নীরব তার অনুগত মানবাধিকারপ্রেমী ও কিছু না করেই মহাবিপ্লবী সাংবাদিককুল। অথচ তারা চোখের সামনেই দেখছেন তাদের দীর্ঘদিনের সহকর্মী বন্ধুরা আচমকা বরখাস্তের চিঠি পেয়ে শুকনো মুখে মাথা নিচু করে অফিস ছাড়ছেন। আলিমুদ্দিনের নির্দেশে যেসব কট্টর সিপিএম ক্যাডাররা সরকার বাড়িতে ঢুকেছিলেন রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর মালিকদের ঠিক মত সার্ভিস দিতে না পারায় তাদেরও চাকরি যাচ্ছে।

এই অবস্থাতেই দীর্ঘদিন পর সরকার বাড়িতে ঢুকে পড়েছে প্রতিবাদের ঝোড়ো হাওয়া। অনির্বাণ দীপশিখা কিংবা স্বাতী নক্ষত্রদের মত উচ্চশিক্ষিত ‘বিবেকবান’ সাংবাদিকরা নয়, রুখে দাঁড়িয়েছেন বাঁকুড়ার বড়জোড়াতে সরকার বাড়ির যে প্রিন্টিং ইউনিট রয়েছে তার উনচল্লিশ জন ঠিকা কর্মী। অন্যায়ভাবে ছাঁটাই হওয়ার প্রতিবাদে এবং পুনর্বহালের দাবীতে এরা সটান কলকাতায় এসে লাগাতার ধর্না শুরু করেছেন আনন্দবাজারের দোরগোড়ায়। এদের সঙ্গে রয়েছেন পরিবারের লোকজন। গত চোদ্দবছর ধরে এই সংবাদ প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন ঠিকাদারদের অধীনে কাজ করছেন এরা। কাজে কোন গাফিলতি নেই। এমনকি বড়জোড়ার ইউনিট ম্যানেজার পুরনো কর্মীদের রেখে দেওয়ার যুক্তি দেখালে উদ্ধত মালিকরা তাকেও ছাঁটাই করে দিয়েছে। স্থায়ী করার দায়িত্ব এড়াতে কুটিল ম্যানেজমেন্টের এই ছক।

অফিসের দোরগোড়ায় স্ত্রী-পুত্র সমেত এই নন এলিট কর্মীদের প্রতিবাদে কোঁচা দোলানো সরকারবাবুরা ছাড়াও মহা সমস্যায় পড়ে গেছেন মালিক অনুগত প্রগতিশীল ও সংস্কৃতিবান সাংবাদিককুল। তারা এই প্রতিবাদকে সমর্থনও করতে পারছেন না আবার উড়িয়েও দিতে পারছেন না। কারণ তারা মনে মনে জানেন এই বিদ্রোহ ন্যায়সঙ্গত। বহু বছর পর এই কাগজের মালিকরা একটা সত্যিকারের প্রতিবাদের সামনে পড়েছেন। এই প্রতিবাদকে আগেরবারের মত সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধের অপচেষ্টা বলে দেগে দেওয়া যাবেনা। এ হল দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া সংবাদপত্র কর্মীদের প্রতিবাদ। যা প্রদীপের নিচে অন্ধকারকে সামনে নিয়ে এসেছে।

বছরের পর বছর ধরে মেরুদণ্ডহীন সাংবাদিকদের দেখতে অভ্যস্ত আমার মত মানুষের কাছে এই মানুষগুলো এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। চারশো জন কর্মী ছাঁটাই হওয়ার পরও আমরা যে কাজ করতে পারিনি আপনারা তা করে দেখিয়েছেন। স্যালুট বড়জোড়ার ভাইরা। আপনারা এভাবে প্রতিবাদ না করলে আমরা জানতেই পারতাম না পৃথিবীর সব জায়গার মত প্রতিবাদটা সংবাদপত্র, বিশেষকরে আনন্দবাজারের অফিসেও আছে। মালিকরা স্বীকার করুন বা না করুন এই প্রতিবাদে আনন্দবাজারের ব্র্যান্ড ভ্যালুও বিরাট ধাক্কা খেয়েছে।

আমার মনে পড়ছে রবীন মজুমদারের সেই পুরনো গানটা ‘আমার আঁধার ঘরের প্রদীপ যদি নাই বা জ্বলে’। ‘নাই বা জ্বলে বলে’ হাল ছেড়ে দিয়ে অবস্থার দাসত্ব না করে সংবাদপত্রের প্রতিবাদহীন আঁধার ঘরে আপনারাই জ্বেলে দিয়েছেন প্রতিবাদের প্রদীপ। বড়জোড়া থেকে আসা দমকা হাওয়ার মত আসা এই প্রতিবাদ বুকে নিয়ে আমরা আরও অনেকটা পথ হাঁটবো।

অশোক মজুমদার

admin

Share
Published by
admin

Recent Posts

সিএএ নিয়ে প্রচারে মনোরঞ্জন, সাবধান করছেন এলাকার

২৪ এর লোকসভা ভোটে রাজ্যে অন্যতম ইস্যু হয়ে উঠেছে সিএএ। বিজেপির পক্ষ থেকে এই নিয়ে…

2 days ago

সন্দেশখালির ঘটনা সাজানো, বিজেপির পরিকল্পিত চিত্রনাট্য, ভাইরাল ভিডিয়োই দাবি বিজেপি নেতার

সন্দেশখালির ঘটনা নিয়ে এবার নয়া মোড়। সন্দেশখালি আন্দোলন থেকে শুরু করে যা যা ঘটেছে সম্পূর্ণটাই…

2 days ago

“আহা কী আনন্দ আকাশে বাতাসে”- কুনাল ঘোষের গলায় কেন এই গান?

বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিলেন। বেশ কিছুদিন ধরে বেশ কিছু বিষয় নিয়ে দলবিরোধী কথা বলছিলেন। বিশেষ করে…

2 days ago

“সনাতন বিরোধী তৃণমূল”- দৈনিক সংবাদপত্রে বিজেপির বিজ্ঞাপন , প্রচারে ‘ধর্ম’ ব্যবহার করায় কমিশনে তৃণমূল

বিজেপির বিজ্ঞাপনে 'ধর্ম' হাতিয়ার, নির্বাচন কমিশনের নজরে আনল তৃণমূল কংগ্রেস। যেখানে নির্বাচন কমিশনের নির্দেশিকায় স্পষ্ট…

2 days ago

বিগত বছরে বিদ্যুতের মাশুল বৃদ্ধি হয় নি, দাবি WBSEDCL এর

বিদ্যুতের মাশুল বৃদ্ধি হয়েছে বলে মিথ্যে রটনা শুরু হয়েছে। বিগত বছরে এমন কোন মাশুল বৃদ্ধি…

2 days ago

হেলিকপ্টারে আগুনের ঘটনায় থমকে নেই দেব, শনিবার দলীয় প্রার্থীদের সমর্থনে চুটিয়ে প্রচার

হেলিকপ্টারে হঠাৎ আগুন। বড় বিপদের হাত থেকে রক্ষা পান অভিনেতা তথা তৃণমূল প্রার্থী দেব। তবে…

2 days ago
https://www.banglaexpress.in/ Ocean code: