জনসমুদ্রে লেগেছে জোয়ার…

ভিড় এক বিচিত্র চরিত্র। কখনও ভীরু মানুষকে নিমেষে তা সাহসী করে তোলে কখনও বা তা পিছনে না থাকলে সর্বত্যাগী নেতাও মুষড়ে পড়েন, ভাবতে থাকেন তাহলে আমার কি কোন ভুল হচ্ছে? আবার কুম্ভে কিংবা গঙ্গাসাগরের জনপ্লাবনে আমি দেখেছি এক অন্য জনস্রোত, যা পুণ্যের আশায়, মোক্ষের লোভে যাবতীয় কষ্টকে তুচ্ছ করছে। রাজনীতির ভিড় আবার অন্যরকম। কোন দলের ভাল কাজ বা মনমোহিনী প্রতিশ্রুতি বা সাফল্যে নেতা বা নেত্রীর পিছনে ভিড় করেন জনগণ। আবার ভুল সিদ্ধান্ত, দুর্নীতি বা মানুষের প্রকৃত চাহিদা বুঝতে ব্যর্থ হলে সে ভিড় সরে যেতে সময় লাগেনা। গতকাল ২১শের শহিদ স্মরণের মঞ্চে দিদির ভাষণের সময় মঞ্চের ওপর থেকে চারপাশের জনারণ্যের দিকে তাকিয়ে আমার বারবার এসব কথা মনে পড়ছিল।

প্রতি বছরই দিদির ভাষণের সময় মঞ্চ থেকে নানা অ্যাঙ্গেলে এই ভিড়কে লক্ষ্য করে চলেছি আমি। লক্ষ্য করেছি এই ভিড়ের চেহারা ও চরিত্র বদলে যাওয়া। দেখেছি এই জনস্রোতে গ্রাম ও শহরের সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে গেছেন শহরের উচ্চকোটির সাংস্কৃতিক ব্যাক্তিত্ব ও নানা স্তরের বুদ্ধিজীবীরা। দেখছি কীভাবে বাড়ছে মহিলাদের সংখ্যা এবং আদিবাসী মানুষদের অংশগ্রহণ। কীসের আশায়, কোন উদ্দীপনা বুকে নিয়ে দূরদূরান্ত থেকে দু তিন দিন আগে থেকে এরা শহরে এসে পড়েন এটাও আমাকে ভাবায়।

দীর্ঘ দিন ধরে পশ্চিমবঙ্গের নানা ধরণের রাজনৈতিক দলের সমাবেশের ছবি তুলেছি আমি। দেখেছি বামপন্থীদের সভার ভিড় পাতলা হয়ে যেতে। দেখেছি কংগ্রেসিদের জনসভায় মানুষ কীভাবে দ্রুত কমে আসছে। নকশালপন্থীদের সমাবেশ ও মিছিলে শপথ, আত্মবিশ্বাস, উদ্দীপনা ক্ষীণ হয়ে যাওয়ার ছবিও আমি ভিড়ের চরিত্র থেকেই পেয়ে গেছি। প্রতিবছর ধর্মতলায় এই ২১শে জুলাইয়ের সমাবেশ কিন্তু সত্যিই আমায় অবাক করেছে। এই নিয়ে সমাবেশের ২৫ বছরের প্রতিটিতেই আমি দিদির সঙ্গে থাকলাম। প্রথম দিকে সরকার বাড়ির চিত্রসাংবাদিক হিসেবে, শেষ চার বছর, সরকার নবান্ন। এখানে ভিড় যেন প্রতিবছর বাড়ছে। বাড়ছে এই ভিড়কে সামলানোর শৃঙ্খলা। ব্যবস্থাপনার চরিত্রও হয়ে উঠছে আধুনিক থেকে অত্যাধুনিক। এটাকেও আমার একটা ব্যতিক্রমী ঘটনা বলে মনে হয়। কারণ, আর কোন দলের ক্ষেত্রে এই ঘটনাটা আমি ঘটতে দেখিনা। দেশের অন্য কোথাও কোন রাজনৈতিক সমাবেশে এমন ঘটনা ঘটে বলে আমার জানা নেই।

আগে দেখতাম, সিপিএমের কোন বড় সমাবেশের আগে এসে পাড়ার জেঠু, কাকুরা মাকে এসে বলতো, বৌদি চারটে রুটি করে রাখবেন, ব্রিগেডে আমাদের মিটিং। গ্রাম থেকে আসা আমাদের কমরেডদের খাওয়ার জন্য লাগবে। এভাবে কোন বাড়ি থেকে সংগৃহীত হত রুটি, কোন বাড়ি থেকে আলুর দম। চাল, ডাল, টাকাপয়সা সংগৃহীত হতেও দেখেছি। কোন জবরদস্তি নয় , বিনীত অনুরোধেই বাম রাজনীতির সঙ্গে সংস্রববিহীন মানুষরাও এতে সাড়া দিতেন। আর ব্রিগেড কিংবা ময়দানের জনসভায় বামপন্থী নেতারা কি বললেন তা জানতে পরেরদিন খবরের কাগজ নিয়ে কাড়াকাড়ি হত। তাদের ৩৫ বছরের জমানায় শেষদিকে কিন্তু এই ছবিটা একদম বদলে গিয়েছিল। তাদের সম্পর্কে মানুষের আগ্রহ ও উৎসাহ যে কমে আসছে তা কিন্তু তাদের শেষদিকের জনসমাবেশের চেহারা ও চরিত্র দেখেই বোঝা গিয়েছিল। তাদের মিছিল ও সমাবেশে আসা মুখগুলিতেও আর সেই আশা আকাঙ্ক্ষা আর উদ্দীপনা পরবর্তীকালে দেখিনি। শেষদিকে সর্বশক্তি প্রয়োগ করেও ব্রিগেড ভরাতে তাদের রীতিমত বেগ পেতে হত।

বলছিলাম সমাবেশের ভিড়ের চরিত্রের কথা। আমি দেখেছি দল বড় বা ছোট যাই হোক না কেন তাদের সঙ্গে থাকা মানুষের রাজনৈতিক চেতনা ও বিশ্বাস কিন্তু সমাবেশের চরিত্র বদলে দেয়। যেমন, এস ইউ সি ছোট দল কিন্তু অত্যন্ত শৃঙ্খলাপরায়ণ। তাদের মিটিং, মিছিলেও সেই ছবিটা ফুটে উঠত। প্রবল বৃষ্টিতেও মিছিল করে যেতেন তাদের কর্মীরা, সমাবেশ চলাকালীন বৃষ্টি আসলেও তাড়াহুড়ো করে মাথা বাঁচাতে ছুটে যেতে তেমন দেখিনি। আবার নকশালপন্থীদের মিছিল ও সমাবেশেও একই শৃঙ্খলা দেখতাম। বাড়তি পাওনা হিসেবে যেটা ছিল তা হল এতে অংশগ্রহণকারী তরুণ তরুণীদের বিপ্লবের স্বপ্ন দেখা চোখমুখ ও সমাজ বদলে দেওয়ার শপথ। প্রতিটি শ্লোগান যেন বিশ্বাস ও বুকের ভিতর থেকে উঠে আসতো। বিশাল নয়, কিন্তু তাদের সমাবেশগুলো ছিল একেবারে অন্যরকম। দূর গ্রাম থেকে আদিবাসী এবং প্রান্তিক কৃষকরাও সেখানে আসতেন। সবচেয়ে বড় কথা হল আগতরা কেউই মিছিল বা সমাবেশে আসার নামে কলকাতার বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াতেন না।

মঞ্চে দাঁড়িয়ে এবং মঞ্চ থেকে নেমে ভিড়ে মিশে যেতে যেতে আমার বারবার মনে হয়েছে এবারের সমাবেশ আগের সব সমাবেশকে হা্রিয়ে দিয়েছে। টানা বৃষ্টিতেও এই ভিড়ের শৃঙ্খলা টাল খায়নি। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুরো ভাষণ শুনেই তারা উঠেছেন। এই মানুষরাই যে কোন দলের সম্পদ। দিদি বারবার বলেন, এরাই তার ভগবান। এই মুখগুলোর পাশেই তিনি সারা জীবন থাকতে চান। গরীব ও নিম্নবিত্ত মানুষরা যার সঙ্গে থাকবেন তিনিই জিতবেন। এই মানুষগুলোকে কোন প্রলোভন দেখিয়ে কিনে নেওয়া যায় না। এদের জিতে নিতে হয় কাজ দেখিয়ে। শুধু মুখের কথায় এদের বিশ্বাস অর্জন করা যায় না। কন্যাশ্রী থেকে রুপশ্রী পর্যন্ত বাংলার বিভিন্ন প্রকল্পের সুফলই এদের দিদির পাশে টেনে এনেছে। এই কাজের ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলেই এরা সরকারের পাশে থাকবেন এটা দিদি জানেন বলেই তিনি প্রকল্পগুলির সফল রূপায়নের ওপর জোর দেন। প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীদের নিয়ে পৌঁছে যান রাজ্যের জেলাগুলিতে।

ভাবছিলাম, মঞ্চের এই ভিড়ের পিছনে রয়েছে তার কর্মের সুফল। ম্লান, বঞ্চিত মুখগুলিতে হাসি ফুটিয়েছেন তিনি। এটাই তো রাজনীতিকদের কাজ। আজকের রাজনীতিকদের একটা বড় অংশই তা না করে স্রেফ ভঙ্গি দিয়েই মন ভোলাতে চেষ্টা করেন। তাই তাদের চারপাশে জড়ো হওয়া ভিড়ও পাতলা হয়ে যায়। তারা তা জানতেও পারেন না। যা ঘটেছে বামেদের ক্ষেত্রে। যা ঘটছে মোদীর ক্ষেত্রে। অনেকে ভিড়ে ভয় পান, তারা একটু গা বাঁচিয়ে চলার চেষ্টা করেন। তাদের আবার আদানি, আম্বানিদের সঙ্গই বেশি পছন্দ! কিছু মুষ্টিমেয় শহুরে বুদ্ধিজীবী কি বলছেন তা দিদির কাছে খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। তিনি বিশ্বাস করেন বঞ্চিত সাধারণ মানুষের ইচ্ছেপূরণই রাজনীতির আসল কাজ। রাজনীতিবিদরাই এই জনসমুদ্রের শক্তিকে উন্নয়নের উৎসে পরিণত করতে পারেন। দিদি ঠিক এই কাজটাই করছেন। এবারের শহিদ স্মরণ সমাবেশ একথাই আরও একবার প্রমাণ করে দিল।

Satwajit Mondal

Share
Published by
Satwajit Mondal

Recent Posts

রাজ্যপালের বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগ: মন্তব্য করলেন চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য

রাজভবনের এক কর্মীর অভিযোগ হেয়ার স্ট্রিট থানায় রাজ্যপালের বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগ। রাজভবনে অস্থায়ী কর্মী হিসেবে…

1 day ago

মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার আগে নিজে রক্তদান করলেন ঘাটালের তৃণমূল প্রার্থী দেব

সামাজিক বার্তা, পরিবেশ বার্তা। নিজের মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার আগে নিজে রক্তদান করলেন ঘাটালের তৃণমূল প্রার্থী…

1 day ago

কুণাল ঘোষকে তৃণমূলের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক পদ থেকে সরিয়ে দিল রাজনীতির অবসান বা শুরু?

রাজনীতির সময়ে অনেক সময় আসে যখন সাধারণভাবে একজন রাজনৈতিক কর্মীর কাছে এক পদ দিয়ে দেওয়া…

3 days ago

রজনীকান্ত এবার সবচেয়ে বেশি পারিশ্রমিক নিয়ে সব রেকর্ড ভেঙে দিলেন

তিনি ভারতীয় তামিল চলচ্চিত্রের মহাতারকা রজনীকান্ত। শুধু তামিল ভাষাতেই হিন্দি, তেলেগু, কন্নড় ও ইংরেজি ভাষার…

3 days ago

নির্মাতা অনিরুদ্ধ’র আরেকটি ছবিতে অভিনয় করতে যাচ্ছেন জয়া

কলকাতার নির্মাতা অনিরুদ্ধ রায়চৌধুরী পরিচালিত ‘কড়ক সিং’ নামের হিন্দি ছবির মাধ্যমে বলিউডে অভিষেক হয়েছে বাংলাদেশী…

3 days ago

বলিউড ডিভা শিল্পা শেঠির সম্পত্তির সম্পত্তি বাজেয়াপ্তি: সন্তানসহ মুম্বাই ছেড়ে প্রত্যাবর্তন

বলিউড অভিনেত্রী শিল্পা শেঠির স্বামী রাজ কুন্দ্রা তার আর্থিক মুদ্রার এক ধারালো নিয়ে সম্পত্তি বাজেয়াপ্তি…

3 days ago
https://www.banglaexpress.in/ Ocean code: