মুবারক হো ঈদ

শ্যামলের আজ স্কুল ছুটি তবু সকাল সকাল স্নান সেরেছে। অন্য দিন সব কিছু মাকে করে দিতে হয় কিন্তু আজ মাকে কিছু না বলে গত পুজোয় কেনা পাঞ্জাবী পাজামাটা পরে নেয় তড়িঘড়ি, ওদিকে মা কিছু বুঝতে পারছে না
-কিরে এই সকালে স্নান করে আজ পাঞ্জাবী টাবি পরেছিস কেন রে ?
কোনো কথার জবাব না দিয়ে তৈরি হতে থাকে ক্লাস সিক্সে পড়া শ্যামল।
-মা আমি আসছি, ওপাড়ায় তৌসিফ দের বাড়িতে যাচ্ছি।
কারণ বুঝতে অপারগ মা আকাশ থেকে পড়ে…
এসব কি বলছিস? কোথায় যাচ্ছিস? আর কেন?
-উফ মা, আজকে তো ঈদ, জাননা? বিরক্ত হয়ে বলে শ্যামল।

– ওহ্ আজকে তো ওদের ঈদ, সে ভালো কথা, কিন্তু তুই কেন যাচ্ছিস? আর এইভাবে কেন যাচ্ছিস! স্পর্ধা খুব বেড়েছে না! ছোট্ট শ্যামলকে প্রশ্ন করে ধমকাচ্ছে মা।
– মা তৌসিফ আমার বেষ্ট ফ্রেন্ড! ঈদের অনুষ্ঠানে সে আমায় নিমন্ত্রণ করেছে, তাই যাচ্ছি।
-ওরে আমার ঈদ, তোর ঠাম্মা জানতে পারলে কিন্তু ব্যাবস্থা করেই ছাড়বে
মুসলমানের ঘরের পার্বনে তোকে যেতেই দেবেনা।
বলতে বলতেই ঠাকুমা ভিতরের ঘরের থেকে আওয়াজ দেয়-
-একদম যেতে নেই, ওদের পার্বনে আমাদের কি? ছি ছি জাত ধর্ম সব যাবে দেখছি.!

-না না আমি যাবই যাব- তোমরা আমাকে আটকিও না প্লিজ অনেক প্ল্যান করে রেখেছি দুজনে , কিছুটা আকুতি কিছুটা জেদ করে শ্যামল।
-না মুশলিম ঘরের পার্বণে একদম যাবিনা, এবার ধমক দিতে দিতে বেরিয়ে আসে ঠাকুমা।
শ্যামলের মাও সায় দেয়, বলে -তুই বরং ঘরে বসে গেম খেলনা, একটা দিন ছুটি পেয়েছিস একটু রেস্ট কর। তোর ওখানে কোনো লাভ নেই আর আমাদের ধর্ম ওদের ধর্ম আলাদা, তাই আমাদের যেতে নেই।
অনেক করে বোঝাতে থাকে কিন্ত লাভ হয়না শ্যামল উল্টে প্রশ্ন করে,

-তবে যে তৌসিফ পুজোর সময় আমাদের বাড়ি এসেছিল, একসাথে খেলাম ঘুরলাম কত আনন্দ করলাম তাতে কি ওর জাত গেলো? আর এখন আমায় বলছো যেতে নেই? আমি কথা দিয়েছি না গেলে সে কত রাগ করবে জানো কত দুঃখ পাবে?
-ওসব তুই বুঝবি না,ওদের পার্বন আমাদের পালন করতে নেই। ওদের পার্বন ঈদ, ওরা করুগ্যেযা- তুই কেন যাবি? এটাকি আমাদের পার্বন? শ্যামলকে বাধা দেয় তার মা-ঠাকুমা।

এদিকে নাছোড় শ্যামল ভারী ভারী মুখে আবারো প্রশ্ন করে –
-যখন ওরা আমাদের পুজার সময় আসে আনন্দ করে- তখন যদি ওদের জাত না যায়, আমি গেলে কেন জাত যাবে? এ কেমন নিয়ম,, আর এতই যখন জাত জাত করছো অন্য ধর্মের উৎসবে যদি জাত যায় বলছো তবে বড়দিন তো খ্রিস্টান দের উৎসব, তবে আমাদের বাড়ি কেক কাটা হয় কেন? আমার মাথায় রাঙা তুলার টুপি পরিয়ে, খ্রিসমাস ট্রি এনে উৎসব হয় কেন? শুধু আমাদের না পাড়ায় সবার বাড়িতেই তো দেখি পালন হয় খ্রীস্টান দের পার্বণ তখন তোমাদের জাত যায়না? প্রচণ্ড চিৎকার করে বলতে থাকে শ্যামল।
কিছুক্ষণ নিস্তব্ধ থাকতে হয় সবাইকে-

ছোট মানুষের মুখে এই সোজা সত্য কথাগুলি নির্বাক করে দেয়, সকলে চুপ এখন। কোন উত্তর খুঁজে পাওয়ার আগেই পাওয়া গেল একটি হাসিমুখ, শ্যামলের বাবা-
-আমি সব শুনেছিরে শ্যামল, দোষ শুধু তোর মা-ঠাম্মার নয়রে। দোষ আমাদের গোটা সমাজব্যবস্থার, ধর্মের নামে দোহাই দিয়ে একে অপরকে দুরে ঠেলে দিয়েছি, বিভেদের দেওয়াল তুলে দিয়েছি আমরা। একটা বিদেশি ধর্মিয় আচারণ ক্রিস্টমাসে মেতে উঠতে আমাদের দ্বিধা হয়না, অথচ পাশাপাশি এত কাল থেকেও আরো একটা পার্বন হিসেবে ঈদ উৎসবকে আপনাতে পারিনি, মুখে বললেও মন থেকে কখনই মেনে নিতে পারিনি- শুধু গোঁড়ামি আর বিভেদের কারণেই হয়ে আসছে, অথচ ‘বিভেদের মাঝে দেখ মিলন মহান’ গর্ব করে বলে বেড়াই এই আমরাই ।

কোন বাধা দেবনা, তুই যাবি- ঈদের আনন্দ ভাগাগাগি করে নিতে যাবি তুই। সমাজে যতদিন গোঁড়ামি থাকবে ততদিন বিভেদ থাকবে, এটা আমাদেরই দোষ…আমাদেরকেই এই বিকৃত বিভেদ ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
রাগে লাল হয়ে যায় ঠাম্মা, মাথা নেড়ে মা থাকে চুপ করে,
এসবের মাঝে এমন সময় ছুটতে ছুটতে তৌসিফ এসে হাজির। হাতে তার একটা টিফিন কৌটো।

-আমি অপেক্ষা করছিলাম রে শ্যামল… কিন্তু কেন জানি না মা বলছিল তুই নাকি আমাদের বাড়িতে আসবিনা- তাই একটু লাচ্চা আর পায়েস নিয়ে এলাম, এখনো গরম আছে হাত দিয়ে দ্যাখ। তারপরে চল একসাথে বেড়াবো খেলবো আর মেলায় যাবো। শ্যামল চেয়ে দ্যাখে বাবা মায়ের দিকে- ছলছলে চোখে মায়ের দিকে চেয়ে বলে -যেতে দাওনা মা! ও আমার বেস্ট ফ্রেন্ড প্লিজ মা একটু যাই না!
কারো মুখে কোন কথা নেই এখন- মাথা নিচু করে ইতস্তত ভাবে দাঁড়িয়ে আছে দুটি কিশোর, মাঝখানে বিভেদের অদৃশ্য দেয়াল। এ ওর দিকে মুখ চাওয়া-চায়ি করছে দু জোড়া ছলছলে চোখ, দাঁড়িয়ে আছে কয়েকটা প্রশ্ন আর প্রতিক্ষা নিয়ে। সে যাবে কি যাবে না..? তৌসিফ বলে ঠিক আছে কাকিমা শ্যামল না হয় না গেল কিন্তু এই লাচ্ছা আর হালোয়াটা আমার মা দিয়ে পাঠিয়েছে প্লিজ এটা রাখুননা। মা এবার বাবার দিকে তাকায়, মুখ দেখে বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না, হটাৎ করে মা বলে ওঠে

-না, শ্যামল যাবেনা; তুমি বরং তোমার টিফিন বক্সটা বাড়িতেই নিয়ে যাও আর তোমার মাকে গিয়ে বলো এইটুকু লাচ্চা-সিমাই দিয়ে আর কি হবে; শ্যামল একা নয়, আমরা সবাই আসছি তোমাদের বাড়িতে ঈদের আনন্দ ভাগ করে নিতে-
–ইয়ে..এ-এ-এ…..!
আনন্দে লাফিয়ে ওঠে শ্যামল আর তৌসিফ, বুকে বুক রেখে জোরসে জাপটে ধরেছে একে অপরকে, কিছুতেই ছাড়ছেনা যেন এক বৃন্তে সেই দুটি কুসুম,বড় অদ্ভুত উজ্জ্বল বড় উজ্জ্বল সে দৃশ্য।

বিভেদের বেড়া ভেঙে একছুটে চলে যাচ্ছে দুটি কিশোর অনেক কিছু পেরিয়ে ছুটেই চলেছে…ছুটেই চলেছে, যেন ছুটেই চলেছে আগামীর বাংলা তথা ভারতবর্ষ, ভীষণ তার গতি…।

বাতাসে ভাসছে খুশির খুশি সৌহার্দ্যের শব্দ __ঈদ মুবারক- ঈদ মুবারক…!!

আপ্পি হ্যান্স

admin

Share
Published by
admin

Recent Posts

সিএএ নিয়ে প্রচারে মনোরঞ্জন, সাবধান করছেন এলাকার

২৪ এর লোকসভা ভোটে রাজ্যে অন্যতম ইস্যু হয়ে উঠেছে সিএএ। বিজেপির পক্ষ থেকে এই নিয়ে…

2 weeks ago

সন্দেশখালির ঘটনা সাজানো, বিজেপির পরিকল্পিত চিত্রনাট্য, ভাইরাল ভিডিয়োই দাবি বিজেপি নেতার

সন্দেশখালির ঘটনা নিয়ে এবার নয়া মোড়। সন্দেশখালি আন্দোলন থেকে শুরু করে যা যা ঘটেছে সম্পূর্ণটাই…

2 weeks ago

“আহা কী আনন্দ আকাশে বাতাসে”- কুনাল ঘোষের গলায় কেন এই গান?

বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিলেন। বেশ কিছুদিন ধরে বেশ কিছু বিষয় নিয়ে দলবিরোধী কথা বলছিলেন। বিশেষ করে…

2 weeks ago

“সনাতন বিরোধী তৃণমূল”- দৈনিক সংবাদপত্রে বিজেপির বিজ্ঞাপন , প্রচারে ‘ধর্ম’ ব্যবহার করায় কমিশনে তৃণমূল

বিজেপির বিজ্ঞাপনে 'ধর্ম' হাতিয়ার, নির্বাচন কমিশনের নজরে আনল তৃণমূল কংগ্রেস। যেখানে নির্বাচন কমিশনের নির্দেশিকায় স্পষ্ট…

2 weeks ago

বিগত বছরে বিদ্যুতের মাশুল বৃদ্ধি হয় নি, দাবি WBSEDCL এর

বিদ্যুতের মাশুল বৃদ্ধি হয়েছে বলে মিথ্যে রটনা শুরু হয়েছে। বিগত বছরে এমন কোন মাশুল বৃদ্ধি…

2 weeks ago

হেলিকপ্টারে আগুনের ঘটনায় থমকে নেই দেব, শনিবার দলীয় প্রার্থীদের সমর্থনে চুটিয়ে প্রচার

হেলিকপ্টারে হঠাৎ আগুন। বড় বিপদের হাত থেকে রক্ষা পান অভিনেতা তথা তৃণমূল প্রার্থী দেব। তবে…

2 weeks ago
https://www.banglaexpress.in/ Ocean code: