লকডাউন আর তার ফলে উদ্ভূত প্রবল ব্যবসায়িক মন্দার জেরে ক্ষতির মুখে মাদুর শিল্পে

হাওড়া,উদয়নারায়নপুর: গ্রামেগঞ্জে মাটির বাড়ি কিমবা কুঁড়েঘরের সংখ্যা ক্রমশ কমছে।কিন্তু,আজও গ্রাম বাংলার বহু বাড়িতে অতিথি আপ্যায়নের অন্যতম অঙ্গ হিসাবে মাদুর ব্যবহার করা হয়।বাড়ির উঠানে কিমবা দাওয়ায় মাদুর পেতে এখনো গল্প করতে চোখে পড়ে গ্রাম বাংলার মা-বোনেদের।মাদুর বুনেই পেট চলে এরাজ্যের বহু পরিবারের।তাদের মধ্যে গ্রামীণ হাওড়ার উদয়নারায়ণপুর ব্লকের কিসমত কানুপাট অন্যতম।এই গ্রামের প্রায় ২০ টি পরিবারের অন্ন সংস্থান নির্ভর করে মাদুর শিল্পের উপর।কিন্তু,দীর্ঘ লকডাউন আর তার ফলে উদ্ভূত প্রবল ব্যবসায়িক মন্দার জেরে দু’বেলা দু’মুঠো ভাত জোটানোই দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে মোহন,রবি,কালোসোনাদের।পরিবার বাঁচাতে বাধ্য হয়ে পূর্ব পুরুষের পেশা ছেড়ে ওদের কেউ একশো দিনের কাজে লেগেছেন কেউবা অন্যের জমিতে কাজ করছেন।

উল্লেখ্য,উদয়নারায়ণপুরের মনশুকা পঞ্চায়েতের কানুপাট গ্রামেই মাদুর কাঠির চাষ হয়।সেখান থেকেই কিসমত কানুপাটের মাদুর শিল্পীরা মাদুরকাঠি কিনে আনেন।মাদুর শিল্পীরা জানিয়েছেন,একগোছা বড়ো,মাঝারি ও ছোটো মাদুরকাঠির দাম পড়ে যথাক্রমে ৪০০,৩০০ ও ১৫০ টাকা।পুরুষদের পাশাপাশি সংসারের কাজ সামলে মহিলারাও মাদুর বোনেন।একজন পুরুষ শিল্পী একটি মাদুর বুনতে ৫-৬ ঘন্টা নেন।মহিলা শিল্পীদের যেহেতু সংসারও সামলাতে হয় তাই একটি মাদুর বুনতে তাঁদের দেড় থেকে দু’দিন লেগে যায়।তারপর মাদুরগুলি নিয়ে কানুপাটের সুভাষ হাটে বুধ ও শনিবার রওনা দেন শিল্পীরা।ভোরের আলো ফোটার সাথে সাথেই শুরু হয় হাটের বেচাকেনা।হাটে পাইকারী বিক্রেতারা শিল্পীদের থেকে মাদুর কেনেন।কিন্তু,স্বাভাবিক সময়ের এই সচরাচর ছবিটা করোনার ধাক্কায় অনেকটাই পাল্টে গেছে।একদিকে যেমন বেড়েছে কাঁচামালের দাম,তেমনই অন্যদিকে মাদুরের চাহিদা একধাক্কায় অনেকটাই কমেছে।আর তার জেরেই চরম বিপাকে পড়েছেন মাদুর শিল্পীরা।কাঠি কিনে এনে শিল্পীরা শ্রম দিয়ে মাদুর বুনে সুভাষ হাটে নিয়ে এলেও হাটে ক্রেতাদের দেখা মিলছে না।তাই বাধ্য হয়ে একরাশ হতাশা আর নিজেদের হাতে বোনা শিল্পকর্মকে নিয়ে বাড়ি ফিরতে হচ্ছে শিল্পীদের।গত শনিবারই হাটে চারটি মাদুর নিয়ে গিয়েছিলেন রবি সেনাপতি।কিন্তু তিনি হতাশার সুরে জানালেন,”৪ টে মাদুরই বাড়ি ফিরে আনতে হয়েছে।”বছর পঁয়ষট্টির শিল্পী মোহন মাঝি দীর্ঘদিন ধরে এই শিল্পের সাথে যুক্ত।তাঁর কথায়,”আমাদের বংশপরম্পরায় এই হস্তশিল্প চলে আসছে।আমি আট বছর বয়স থেকে মাদুর বোনার কাজ করছি।কিন্তু এরকম চরম দুর্দশা কখনো হয়নি।”এই চরম মন্দার জেরে মাদুরশিল্প থেকে মুখ ঘুড়িয়ে নিয়েছেন গ্রামের একাধিক শিল্পী পরিবার।২০ টি পরিবারের মধ্যে ১৮ টি পরিবার আপাতত কাজ বন্ধ রেখেছে।মাত্র দু’টি পরিবার কোনোরকমে এই কাজ চালাচ্ছে।শিল্পী কালোসোনা মাঝি বলেন,”আমার পাঁচ মেয়ে।এই পেশার উপরই আমার সংসার নির্ভরশীল।কিন্তু,দীর্ঘদিন কোনো কাজ না থাকায় অন্য কাজে যেতে হচ্ছে।নাহলে খাব কী!”

সর্বগ্রাসী করোনার করাল গ্রাসে বাংলার ঐতিহ্যবাহী হস্তশিল্পগুলি এভাবেই যেন ফিকে হতে বসেছে।পেটের টানে হারিয়ে যেতে বসেছে শিল্পীর শিল্পসত্ত্বা।কবে আবার শিল্পে সুদিন আসবে?—এখন এই প্রশ্নই ঘুরে বেড়াচ্ছে কিসমত-কানুপাটের শিল্পী পরিবারগুলিতে।

admin

Share
Published by
admin

Recent Posts

সিএএ নিয়ে প্রচারে মনোরঞ্জন, সাবধান করছেন এলাকার

২৪ এর লোকসভা ভোটে রাজ্যে অন্যতম ইস্যু হয়ে উঠেছে সিএএ। বিজেপির পক্ষ থেকে এই নিয়ে…

3 days ago

সন্দেশখালির ঘটনা সাজানো, বিজেপির পরিকল্পিত চিত্রনাট্য, ভাইরাল ভিডিয়োই দাবি বিজেপি নেতার

সন্দেশখালির ঘটনা নিয়ে এবার নয়া মোড়। সন্দেশখালি আন্দোলন থেকে শুরু করে যা যা ঘটেছে সম্পূর্ণটাই…

3 days ago

“আহা কী আনন্দ আকাশে বাতাসে”- কুনাল ঘোষের গলায় কেন এই গান?

বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিলেন। বেশ কিছুদিন ধরে বেশ কিছু বিষয় নিয়ে দলবিরোধী কথা বলছিলেন। বিশেষ করে…

3 days ago

“সনাতন বিরোধী তৃণমূল”- দৈনিক সংবাদপত্রে বিজেপির বিজ্ঞাপন , প্রচারে ‘ধর্ম’ ব্যবহার করায় কমিশনে তৃণমূল

বিজেপির বিজ্ঞাপনে 'ধর্ম' হাতিয়ার, নির্বাচন কমিশনের নজরে আনল তৃণমূল কংগ্রেস। যেখানে নির্বাচন কমিশনের নির্দেশিকায় স্পষ্ট…

3 days ago

বিগত বছরে বিদ্যুতের মাশুল বৃদ্ধি হয় নি, দাবি WBSEDCL এর

বিদ্যুতের মাশুল বৃদ্ধি হয়েছে বলে মিথ্যে রটনা শুরু হয়েছে। বিগত বছরে এমন কোন মাশুল বৃদ্ধি…

3 days ago

হেলিকপ্টারে আগুনের ঘটনায় থমকে নেই দেব, শনিবার দলীয় প্রার্থীদের সমর্থনে চুটিয়ে প্রচার

হেলিকপ্টারে হঠাৎ আগুন। বড় বিপদের হাত থেকে রক্ষা পান অভিনেতা তথা তৃণমূল প্রার্থী দেব। তবে…

3 days ago
https://www.banglaexpress.in/ Ocean code: