জন্ম-মৃত্যুতে কবি প্রণাম

জন্ম-মৃত্যুতে কবি প্রণাম
সত্যজিৎ মণ্ডল

‘বৈশাখের শুরুতে বাংলা ক্যালেন্ডার হাতে নিয়ে প্রথমেই গোল করে দাগ দিয়ে রাখতাম ২৫শে বৈশাখ আর ২২শে শ্রাবণ তারিখ দুটিতে। অভিপ্রায় ইংরেজি তারিখ কবে পড়েছে’। এমনি কথা বলতে পারা এক রবীন্দ্র অনুরাগীর কাছ থেকে কত কথাই শোনার রবীন্দ্রনুভূতি আছে।যা মন মনন কে নাড়া দিয়ে যায়। তিনি ডঃ চৈতালী মুখার্জী, অধ্যাপিকা। আজ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিয়ে সাক্ষাৎকার নেওয়ার ইচ্ছায় বসলে যে সুখনুভূতি উপলব্দি করলাম তার নির্যাস তাঁরিই লেখায়।

জন্মঃ ২৫শে বৈশাখ ১২৬৮।তখনও সূর্যোদয় হতে বেশ কিছুটা বাকি, মহর্ষি বসেছেন উপাসনায় রোজকার মত, ললিত বাজছে গুনেন্দ্রনাথের এসরাজে। আজ মন বসছে না কিছুতেই স্থির হয়ে। কাল সন্ধ্যে থেকেই বড় বৌ এর শরীরটা ভাল নেই। প্রসব যন্ত্রণার পূর্বাভাসই বটে তবে সঙ্গে রয়েছে দীর্ঘ অসুস্থতা আর বৃহৎ এই পরিবারের দায়ভার বহন। এত নতুন নয় তাঁর কাছে। বৃহৎ পিতৃঋণের ব্যয়ভার বহন করছেন তিনি দীর্ঘকাল, সঙ্গে বহন করে চলেছেন সুবৃহৎ পরিবারের দায়িত্ব।তবু কখনও উপাসনায় বিঘ্ন ঘটেছে এমন তো মনে পড়ে না। ” বাবামশায় আপনার শরবত” সৌদামিনী এসে দাঁড়াল সঙ্গে পাথরের গেলাস হাতে ছোট্ট জ্ঞানদানন্দিনী। ” এত সকালে আবার মেজবৌমাকে কেন ডেকে তুললি সদু?” মহর্ষি একটু বিব্রত বোধ করলেন। “আপনাকে সুখবর দিতে এলুম যে, কাল ২টো বেজে ২৮ মিনিটে ছেলে হয়েছে আপনার” কথাটা শেষ হওয়ার আগেই মহর্ষি বলে উঠলেন ” বড়বৌ?” ” মা ছেলে দুজনেই ভাল আছে বাবামশায়”। তারপর একগাল হেসে সৌদামিনী বলল ” তবে এত কালো ছেলে আমাদের বাড়িতে আর একটাও নেই”। “কি যে বলেন বট্ঠাকুজঝি” চমকে উঠলেন মহর্ষি, মেজবৌমার গলা শুনে। অবগুন্ঠন সরিয়ে মুখ তুলে সদ্যোজাত দেবরের পক্ষে প্রথম প্রতিবাদী কন্ঠস্বর। হেসে উঠলেন বাবামশায় “আচ্ছা বেশ বেশ, তুই থাম না সদু?চল আমি দেখে আসি”। ” হ্যাঁ বাবামশায় তাই চলুন “। এমন উজ্জ্বল গভীর দৃষ্টি সদ্যজাত শিশুর চোখে সত্যই বিরল। চমকে উঠলেন মহর্ষি, চতুর্দ্দশতম সন্তানের পিতা। ভোরের আলো এসে পড়েছে শিশুর মুখে, গাত্রবর্ণ তাঁর অন্য সন্তানদের অপেক্ষা শ্যাম হলেও কৃষ্ণাভ নয় একেবারই।শান্ত হয়ে এল পিতার হৃদয়, এক অপূর্ব প্রশান্তিতে পূর্ণ হয়ে উঠল তাঁর চিত্ত বললেন ” ও আমার ভোরের সূর্যের প্রথম আলো ও আমার রবীন্দ্র। মেজবৌমার মাথায় হাত রাখলেন ” মা তুমি সঠিক বলেছ। আমার রবির দায়িত্ব তোমার রইল। তুমি ওকে গড়ে তুলো তোমার মনের মতো করে” কিশোরী জ্ঞানদা গড় হয়ে প্রণাম করলেন বাবামশায়কে। সূর্যের আলো ছড়িয়ে পড়ল পূব আকাশে।

মৃত্যুঃ পূর্ণিমা গিয়ে প্রতিপদে কৃষ্ণপক্ষের সূচনা হল। জোড়াসাঁকোর অট্টালিকা থেকে কবির পার্থিব শরীর নিমতলা মহাশ্মশানে নিয়ে যাওয়ার বর্ননা এসে পৌছালো আশ্রমে।গুরুদেবের শেষ ইচ্ছা পূর্ণ করা গেল না। উন্মত্ত জয়ধ্বনির মধ্যেই তাঁর অমৃতলোকের উদ্দেশ্য যাত্রা সম্পন্ন হল। ঠিক হল ৩২শে শ্রাবণ কবির শ্রাদ্ধানুষ্ঠান হবে ছাতিমতলায়, নিভৃতে, সকল উন্মত্ততা থেকে দূরে। আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন দায়িত্বপ্রাপ্ত গুণীজন। চাঁদের পক্ষ পরিবর্তনের লক্ষণ স্পষ্ট হয়ে উঠতে লাগল।

সেদিন সন্ধ্যায় উপাসনার শেষে উদীচী বাড়ির দোতলার ঘরে বাবামশায়ের বড় তৈলচিত্রটার সামনে এসে দাঁড়ালেন রথীন্দ্রনাথ।সদ্য প্রয়াত পিতার মুখাগ্নি করতে পারেন নি তিনি তাই মনের মধ্যে কেবলই ধন্ধ জাগছে, তবে কি বাবামশায়ই চান নি শেষকৃত্যে তার উপস্থিতি? মীরা এসে দাঁড়াল পাশে। ” আমি কি বাবামশায়কে খুব কষ্ট দিয়েছি রে মীরা?”
“কেন দাদা, একথা বলছ কেন?” “আমি তো পারলাম না রে তাঁর দাহ সংস্কারে উপস্থিত থাকতে।অত ভীড়ের মধ্যে আমার কিছুতেই সাহস হল না বাড়ির বাইরে যাওয়ার।মূল ফটক ভেঙে ফেলল উন্মত্ত জনতা, আমি হতবাক।সব্বাই নিষেধ করল আমায়। ” বাবামশায় কোনদিন এসব সংস্কারে বিশ্বাসী ছিলেন না, তুমি তো জান দাদা।মিথ্যাই মনখারাপ করছ।” নিজের অজান্তেই বুঝি দুফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল পিতার জ্যেষ্ঠ পুত্রের গাল বেয়ে, আবছা আলোয় বোঝা গেল না। ” তুমি তো জান দাদা ঐ দিনটা আমার কাছে কি ভয়ঙ্কর” মীরার গলা বুজে এল। সস্নেহে তার মাথায় হাত রেখে রথী বলল ” জানি বোন, নীতুর চলে যাওয়াটা বাবামশায়ও মেনে নিতে পারেন নি।


তোকে চিঠি লিখে সান্ত্বনা জানালেও কেবলই বলতে লাগলেন নীতু তো ভাল হয়ে উঠছিল, এমন তো হবার কথা নয়। দেখ সেই ২২শে শ্রাবণই আবার দুঃসময়ের স্মৃতি বহন করে এল ৯ বছর পরে”। এবার মীরার বুকফাটা আর্তনাদ আর বাঁধভাঙা অশ্রু পুত্র বিয়োগের স্মৃতি ও পিতৃবিয়োগের বেদনা হয়ে বেরিয়ে এল। বিশ্ববরেণ্য পিতার দুই উত্তরাধিকারী তখন বিপুল দায়িত্ব ও সম্মান রক্ষার ভার ভুলে পিতৃস্নেহচ্ছায়া হারানোর বেদনায় বিধুর।
বনমালী এসে দাঁড়াল দরজার বাইরে ” খোকাবাবু, জানলাটা বন্ধ করে দিই জল হচ্ছে যে”।চমকে উঠল দুজনে।মুখ ফেরালো জানলার বাইরে। স্বচ্ছ জ্যোৎস্নায় বৃষ্টির প্রতিটা কণা ঝকঝক করছে। কবির প্রিয় ঋতু বর্ষা। “বাবামশায় খুব ভালবাসতেন বৃষ্টি দেখতে — তাই না দাদা?”
“খুউউউউব” দু’ভাইবোনে আজ অনেকদিন পরে দোতলার ঘরের জানলায় দাঁড়িয়ে ভরা শ্রাবণের বর্ষণ দেখতে লাগল। মনে পড়ে গেল সেই ছোটবেলায় শান্তিনিকেতন বাড়ির দোতলার ঘরে বাবামশায় যখন পড়াশেনায় ব্যস্ত থাকতেন তখন পাঁচ ভাইবোন মিলে জানলায় দাঁড়িয়ে দেখত দূরে শালবীথির মধ্যে দিয়ে ছুটে আসা ক্ষেপা শ্রাবণ।
: বাবামশায় কি তাঁর আশ্রম ছেড়ে কোথাও যেতে পারেন? তাই তো…..
“আবার শ্রাবণ হয়ে এলে ফিরে
ঝরোঝরো ধারায় মাতি বাজে আমার আঁধার রাতি
বাজে আমার শিরে শিরে।
শ্রাবণ হয়ে এলে ফিরে।

admin

Share
Published by
admin
  • https://www.banglaexpress.in/ Ocean code:

Recent Posts

সিএএ নিয়ে প্রচারে মনোরঞ্জন, সাবধান করছেন এলাকার

২৪ এর লোকসভা ভোটে রাজ্যে অন্যতম ইস্যু হয়ে উঠেছে সিএএ। বিজেপির পক্ষ থেকে এই নিয়ে…

3 days ago

সন্দেশখালির ঘটনা সাজানো, বিজেপির পরিকল্পিত চিত্রনাট্য, ভাইরাল ভিডিয়োই দাবি বিজেপি নেতার

সন্দেশখালির ঘটনা নিয়ে এবার নয়া মোড়। সন্দেশখালি আন্দোলন থেকে শুরু করে যা যা ঘটেছে সম্পূর্ণটাই…

3 days ago

“আহা কী আনন্দ আকাশে বাতাসে”- কুনাল ঘোষের গলায় কেন এই গান?

বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিলেন। বেশ কিছুদিন ধরে বেশ কিছু বিষয় নিয়ে দলবিরোধী কথা বলছিলেন। বিশেষ করে…

3 days ago

“সনাতন বিরোধী তৃণমূল”- দৈনিক সংবাদপত্রে বিজেপির বিজ্ঞাপন , প্রচারে ‘ধর্ম’ ব্যবহার করায় কমিশনে তৃণমূল

বিজেপির বিজ্ঞাপনে 'ধর্ম' হাতিয়ার, নির্বাচন কমিশনের নজরে আনল তৃণমূল কংগ্রেস। যেখানে নির্বাচন কমিশনের নির্দেশিকায় স্পষ্ট…

3 days ago

বিগত বছরে বিদ্যুতের মাশুল বৃদ্ধি হয় নি, দাবি WBSEDCL এর

বিদ্যুতের মাশুল বৃদ্ধি হয়েছে বলে মিথ্যে রটনা শুরু হয়েছে। বিগত বছরে এমন কোন মাশুল বৃদ্ধি…

3 days ago

হেলিকপ্টারে আগুনের ঘটনায় থমকে নেই দেব, শনিবার দলীয় প্রার্থীদের সমর্থনে চুটিয়ে প্রচার

হেলিকপ্টারে হঠাৎ আগুন। বড় বিপদের হাত থেকে রক্ষা পান অভিনেতা তথা তৃণমূল প্রার্থী দেব। তবে…

3 days ago
https://www.banglaexpress.in/ Ocean code: