বৃহস্পতিবার, ২৮শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৪ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ  
...
Weather Data Source: Wetter Labs
শিরোনাম:

    পাকদণ্ডীর আড়ালে প্রতীক্ষায় বার্মিওক


    বৃহস্পতিবার,১৮/১২/২০১৪
    1410

    ২৯ অক্টোবর, ২০১৪, ০০:০৫:৫২
    2

    ছায়া তাল।

    এনজেপি (নিউ জলপাইগুড়ি) স্টেশন থেকে চলেছি সিকিমের এক প্রায় অচেনা বিউটি স্পট বার্মিওকের পথে। পশ্চিম সিকিমের এই দিকটা হোটেল, রেস্তোরাঁ, বাড়িঘরের ভিড়ে এখনও ঘিঞ্জি হয়ে পড়েনি। হাজারো পর্যটকের পদচারণা, কোলাহল এখনও কলুষিত করতে পারেনি এখানকার পরিবেশকে। অন্য দিকে, কাঞ্চনজঙ্ঘার এক অনবদ্য রূপ দৃষ্টিগোচর হয় এখান থেকে। এই সব কিছু মিলিয়ে মিশিয়ে বার্মিওকের আকর্ষণ তাই অনতিক্রম্য।

    যাত্রাপথটাও চোখজুড়োনো। শিলিগুড়ি শহরের বাইরে আসতেই মহানন্দা অভয়ারণ্যের আকর্ষণীয় সবুজ বিস্তার, সেবক পাহাড়ে করোনেশন ব্রিজ, তিস্তাবাজার পেরিয়ে এগিয়ে চলল গাড়ি। পথের সঙ্গী হল উজ্জ্বল, উদ্দাম তিস্তা নদী। গাছগাছালিতে পরিপুষ্ট সবুজ পাহাড় আর তিস্তার সুন্দর গতিপথ দেখতে দেখতে এক সময় পৌঁছে গেলাম মেল্লি। মেল্লিতে গ্যাংটক যাবার মূল রাস্তাকে ছেড়ে গাড়ি ডান দিকের চড়াই রাস্তাটি ধরল। কিছু দূর যেতেই একটা ব্রিজের ওপর পৌঁছলাম যেখান থেকে নীচে সুন্দর দেখা যায় ‘লাভার্স পয়েন্ট’। দু’দিক থেকে বয়ে আসা তিস্তা ও রঙ্গিত নদী এখানে এসেই একসঙ্গে মিশেছে। এর পর সেই মিলিত জলধারা তিস্তা নামেই বয়ে গেছে সমতলের দিকে। কিছুটা এগোতেই বাংলা-সিকিম সীমান্তের তোরণ (গ্যাংটকগামী রাস্তায় সীমান্ত হল রংপো আর এই রাস্তায় মেল্লি ছাড়িয়ে এই জায়গা) পেরিয়ে গাড়ি ঢুকে পড়ল সিকিমে।

    মারটামের শিরিজঙ্ঘা মন্দির।

    এই বার তিস্তা নয়, রঙ্গিত নদীর পাশ দিয়েই চলেছে যাত্রাপথ। অনুপম নদীবাঁক, চোখজুড়োনো নদী-উপত্যকায় ধানচাষের বিভিন্ন রঙের খেত, রংবেরঙের ফুলের গাছ উপভোগ্য করে তুলেছে পথচলাকে। গাড়ি জোরথাং পৌঁছতে ভাবলাম একটু চা-বিরতি দেওয়া যাক। জোরথাং এই অঞ্চলে বেশ বড় জনপদ। প্রচুর ঘরবাড়ি, বড় বাজার, দোকানপাট, বাস ও ট্যাক্সিস্ট্যান্ড— সব মিলিয়ে একেবারে ব্যস্ত, গমগমে পরিবেশ। চায়ে চুমুক দিতে দিতে ভাবছিলাম ব্যস্ততা, দূষণ, হইচই-এর জায়গা থেকে আসা শহুরে পর্যটকেরা জোরথাং-এ এসে খুব একটা শান্তি পাবেন না। কারণ পরিবেশ ও পরিস্থিতি খুব একটা বিপরীতধর্মী নয়। আর সে কারণেই তো গন্তব্য আমার আরও কিছুটা দূর বার্মিওক-এ।

    এই জোরথাং থেকে দুটো রাস্তায় পৌঁছানো যায় বার্মিওক। একটি রাস্তা রেশি, রিনচেনপং দিয়ে।এটি একটু ঘুরপথ। আমার গাড়ি ধরল জুম হয়ে সোরেং-এর রাস্তা। বার্মিওক পৌঁছনোর শর্টকাট রাস্তা এটাই। পথের ধারে ছোট ছোট গ্রাম, সুন্দর ঘইরবাড়ি, উঠোনে লাগানো বিভিন্ন রঙের ফুলগাছ, শিশুদের হুটোপুটি, এই সব দেখতে দেখতে দুপুর দুপুরই পৌঁছে গেলাম আমার কাঙ্ক্ষিত গন্তব্য বার্মিওক।

    নিরালা, নির্জন পরিবেশ। গাড়িরাস্তা চলে গেছে পাশ দিয়েই। কিন্তু সারা দিনে সে পথে খুব একটা বেশি গাড়ি না যাওয়ায় শব্দদূষণ পীড়া দেয় না সে ভাবে। ৫,৫০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত এই বার্মিওক-এ এসে প্রাণটা যেন জুড়িয়ে গেল। পিলে চমকানো গরমে যখন সমতল ভাজা ভাজা হচ্ছে, তখন এখানে ঠান্ডা হাওয়ার পরশে স্বস্তি অনুভূত হল। দুপুরে পৌঁছেছি বলে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা গেল না। মেঘের অবগুণ্ঠনে ঢাকা পড়েছে সে। হোটেলের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম চারপাশটা। গাছপালার নিবিড় বুনোটে সমৃদ্ধ চারপাশের সবুজ পাহাড়। এলাচের ভাল চাষ হয় এই সব অঞ্চলে। প্রচুর এলাচ গাছও দেখা যাচ্ছে চার ধারে। যে হোটেলে উঠেছি দুপুরে তার বাঙালি পদের সুস্বাদু রান্নায় বেশ অন্য রকম একটা আমেজ চলে এল। বিকেলে রাস্তায় একটু হাঁটা, চেয়ার নিয়ে ব্যালকনিতে বসে তরঙ্গায়িত পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে থাকা, বিচিত্র রঙের পাখির ওড়াউড়ি— এই সব দেখতে দেখতেই সময়টা কেটে গেল।

    হি খোলা ওয়াটার পার্ক।

    পর দিন খুব ভোরে উঠে পড়েছি। ভাগ্য সুপ্রসন্নই বলতে হবে। নির্মেঘ আকাশে সপার্ষদ কাঞ্চনজঙ্ঘার রাজকীয় উপস্থিতি। প্রথম রবিকিরণের রঙিন আলোয় রং পরিবর্তন হতে থাকল তুষারশৃঙ্গের। লাল, গোলাপি ইত্যাদি রঙের বিস্ময়কর দৃশ্যায়নের পর এক সময় ঝকঝকে রুপোলি রূপে থিতু হল বিশ্বের তৃতীয় সর্বোচ্চ তুষারশৃঙ্গ। কাঞ্চনজঙ্ঘার সঙ্গে সঙ্গে কাবরু, রাথোং, কুম্ভকর্ণ ইত্যাদি শৃঙ্গগুলিও বেশ ভালই দেখতে পেলাম এখান থেকে।

    হোটেলে প্রাতরাশ সেরে গাড়ি ভাড়া করে বেরিয়ে পড়লাম আশপাশের দ্রষ্টব্য দেখার জন্য। প্রথমেই গেলাম হি-গ্রামের থেকে আলাদা হওয়া চনাই রাস্তা ধরে ছায়াতলে। প্রায় ৬০০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত এই ছায়াতলে আছে একটি ছোট্ট, সুন্দর তাল, অর্থাৎ সরোবর। চারপাশের ঘন সবুজের প্রতিফলনে তার জলের রংও সবুজ। নিস্তব্ধ পরিবেশে আওয়াজ বলতে শুধু পাখির ডাক। একদম উপরের দিকটায় ইয়ুমা-স্যামিও ধর্মাবলম্বীদের আরাধ্য দেবতা সিরিজঙ্ঘার এক বিরাট মূর্তি তৈরি হচ্ছে। ছায়াতলের কাছেই অবস্থিত রেড-পন্ডা গেট। এখান থেকেই শুরু হয়ে যায় বার্সে রডোডেনড্রন স্যাংচুয়ারির সীমানা। গাড়ির পথ শেষ এই গেট অবধিই। এখান থেকে পায়ে হাঁটা পথ চলে গিয়েছে ঘন জঙ্গলের মধ্য দিয়ে বার্সে পর্যন্ত।

    ছায়াতালের পর রাস্তার ধারেই মাংহিম মন্দির দেখে চলে এলাম সিরিজঙ্ঘা ঝরনা দর্শনে। গাড়ির রাস্তা থেকে অনেকটাই নীচে নামতে হয় (প্রায় আধ ঘণ্টা) পায়ে হেঁটে। উঁচু পাহাড়ের ঘেরাটোপে লুকনো জায়গাটিতে প্রায় ১০০ ফুট উঁচু থেকে লাফিয়ে পড়ছে জলধারা। ভারি দৃষ্টিনন্দন সে দৃশ্য। চার ধারে নিবিড় জঙ্গল। বেশ বড় একটা পাথর দেখলাম জায়গাটিতে, যাকে স্থানীয় মানুষেরা ‘ম্যাজিক বক্স’ আখ্যা দিয়েছেন। ধর্মীয় গুরু সিরিজঙ্ঘার সমস্ত অলৌকিক শক্তি নাকি সেই পাথরের মধ্যেই বিদ্যমান। খুবই পবিত্র এই জায়গা স্থানীয়দের কাছে। দেখা তো হল। কিন্তু বিস্তর চড়াই ভেঙে গাড়ির কাছে পৌঁছতে শহুরে দমের পরীক্ষাও হল বারংবার!

    সিংসর ব্রিজ।

    গাড়ি এ বার নিয়ে গেল হি-খোলা ওয়াটার গার্ডেনে। হি-খোলা নদীধারাকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে সুন্দর এই পার্কটি। বয়সেও খুবই নবীন এই পার্ক। সুন্দর পরিবেশে হাঁটতে হাঁটতে কিছুটা এগোলে দেখা মিলবে বিরাট এক ধর্মচক্রের। ইচ্ছে করলে পায়ে হেঁটে চলে যেতে পারেন আরও ওপরে। যেখান থেকে পুরো জায়গাটিরই একটা সুন্দর ছবি ধরা পড়ে ক্যামেরা ও চোখের লেন্সে।

    ফিরে এলাম হোটেলে। সময়টা মধ্যাহ্নভোজের। স্নান-খাওয়া সেরে এ বার বাকি সাইট-সিয়িং করার জন্য ধরলাম বাঁ দিকের রাস্তা (রিনচেনপং অভিমুখী)। সকাল থেকে যে দ্রষ্টব্যগুলি দেখেছিলাম সেগুলি সবই ছিল এক দিকে, অর্থাৎ হোটেল থেকে বেরিয়ে ডান হাতি রাস্তায়। তবে বার্মিওকের সাইট-সিয়িং-এর মস্ত সুবিধা একটাই যে, কোনও স্পটই ৬-৭ কিলোমিটারের বেশি দূর নয়।

    উত্তরে।

    কালুক বাজার পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম মনাস্ট্রিতে। অতিবুদ্ধের একটি সুন্দর মূর্তি রয়েছে এই মনাস্ট্রিতে। নারী-পুরুষের মিলনে উদ্ভূত শক্তির দ্যোতক এই তান্ত্রিক বুদ্ধমূর্তিটি বাস্তবিকই অভিনব। মনাস্ট্রি দেখে চলে এলাম ওল্ড লেপচা হাউসে। প্রায় ২০০ বছরের প্রাচীন এই বাড়িটি লেপচা উপজাতির নিজস্ব শৈলীর বৈশিষ্ট্যবাহী। অনুমতি নিয়ে ভেতরে ঢুকে ভাল করে দেখলাম কাঠের তৈরি বাড়িটির অন্দরমহল। পরের দ্রষ্টব্য ‘পয়জন লেক’। ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর সঙ্গে লেপচাদের যুদ্ধের সময় এই লেকের জলে লেপচারা বিষ মিশিয়ে দিয়েছিল। এখানে পৌঁছনোর পর সেই জল পান করে অনেক ব্রিটিশ সেনাই সে সময়ে মারা গিয়েছিল। সেই থেকেই এই লেকের নাম হয়ে যায় ‘পয়জন লেক’। এখন যদিও পয়জন লেকে জলের পরিমাণ খুবই কম। তাও ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণে একটা আলাদা জায়গা আছে এই লেকের।

    সবশেষে গাড়ি পৌঁছল রবীন্দ্র স্মৃতিবনে। রবীন্দ্রনাথের স্মৃতির উদ্দেশ্যে নির্মিত এই জায়গাটিতে রবীন্দ্র-কবিতার কয়েক লাইন প্রস্তরফলকে খোদিত দেখে মনটা বেশ পুলকিত হল। পাশেই নবনির্মিত রংচঙে গুরুং গুম্ফা। এখান থেকে বহু দূরের পাহাড়ি দৃশ্য (রা বাংলা পাহাড়ও দৃশ্যমান এখান থেকে) সুন্দর দেখা যায়। দীর্ঘ ক্ষণ সেই দৃশ্য দেখলাম। প্রকৃতির অনাবিল রূপসুধা আকণ্ঠ পান করে অবশেষে ফিরে এলাম বার্মিওক-এ।

    যে উদ্দেশ্য নিয়ে বার্মিওক এসেছিলাম তা পূর্ণ হয়েছে। কাঞ্চনজঙ্ঘা-সহ অন্যান্য তুষারশৃঙ্গের অনিন্দ্যসুন্দর রূপ, বাতাসে অক্সিজেনের ঈর্ষণীয় আধিক্য, স্থানীয় মানুষজনের আন্তরিক ব্যবহার, নিরিবিলিতে নৈঃশব্দে প্রকৃতিকে তার আপন মাধুর্যে দেখতে পাওয়া— সব মিলিয়ে বার্মিওক মনের মধ্যে এক স্থায়ী জায়গা করে নিল!

     

    ছবি: লেখক

    কী ভাবে যাবেন
    এনজেপি স্টেশন থেকে বার্মিওকের দূরত্ব ১৪০ কিলোমিটার। পুরো গাড়ি ভাড়া নিলে খরচ পড়বে ৩০০০-৩৫০০ টাকা। সময় লাগবে ঘণ্টা পাঁচেক। কম খরচে আসতে চাইলে শিলিগুড়ি এসএনটি বাসস্ট্যান্ড থেকে ছাড়া বাস কিংবা শেয়ার জিপে চলে আসুন জোরথাং। সেখান থেকে ডেনটাম বা উত্তরে যাওয়ার শেয়ার জিপ ধরে পৌঁছে যান বার্মিওক। তবে মনে রাখবেন, দুপুরের পর থেকে উত্তরে বা ডেনটাম যাওয়ার গাড়ির সংখ্যা কমে যায় জোরথাং স্ট্যান্ড থেকে। বার্মিওকের সাইট সিয়িং-এ খরচ পড়বে ১৫০০-২০০০ টাকা (পুরো গাড়ি)। ইচ্ছে করলে বার্মিওক থেকেই চলে যেতে পারেন ৩৫ কিলোমিটার দূরবর্তী পেলিং কিংবা সিংশোর ব্রিজ (এশিয়ার দ্বিতীয় উচ্চতম ব্রিজ) পেরিয়ে ২৫ কিলোমিটার দূরবর্তী উত্তরে।
    বরফে ঢাকা কাঞ্চনজঙ্ঘা।
    কোথায় থাকবেন
    হোটেল কাঞ্চনভিউ। দ্বিশয্যার ভাড়া ১০০০-২০০০ টাকা।
    যোগাযোগ: রিশম অ্যাসোসিয়েটস।
    ফোন: ৯০৫১১৬৬৫৬৩, ৯৮৩০২৭১০৬৪।
    এ ছাড়াও রয়েছে হোটেল কালেজ ভ্যালি।
    দ্বিশয্যা ১২০০-১৬০০ টাকা।
    যোগাযোগ: ৯৪৩৪৪৮৯২৭১ এবং ৯৬০৯৮৭৮১৮৭।
    Loading...
    https://www.banglaexpress.in/ Ocean code:

    চাক‌রির খবর

    ভ্রমণ

    হেঁসেল

      জানা অজানা

      সাহিত্য / কবিতা

      সম্পাদকীয়


      ফেসবুক আপডেট



      ‌টেক‌নিক্যাল হেড: ‌মোস্তা‌ফিজুর রহমান
      কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ পিনঃ – ৭০০১২৪
      হোয়াটস্যাপ: (+91) 9733377444
      ই-মেইল : [email protected]
      কার্যনির্বাহী সম্পাদক: সত্য‌জিৎ মন্ডল
      কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ পিনঃ – 700124
      হোয়াটস্যাপ: ( +91) 9733377444
      ই-মেইল : [email protected]
      সম্পাদক: রাজু আলম
      কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ পিনঃ – ৭০০১২৪
      হোয়াটস্যাপ: (+91) 9733377444
      ই-মেইল : [email protected]
      %d bloggers like this: