অজানার সন্ধানে : কৈমুর গুহাচিত্র


বুধবার,০১/০১/২০২০
1280

অজানার সন্ধানে : কৈমুর গুহাচিত্র
প্রথম যাত্রা।

কাজরী মুখোপাধ্যায়

মানুষের দুটি বদ্ধমূল ধারণা আছে।প্রথমতঃ,ছাপার অক্ষর কখনো ভুল হয় না; দ্বিতীয়তঃ,শিক্ষকরা সর্বজ্ঞ হয়।বছর দশেক আগে দুটি ধারণাই আমি মিথ্যা প্রমাণ করেছিলাম, মানে নিজের কাছেই আরকি।ওইসময় উচ্চমাধ্যমিকের পরিবর্তিত পাঠ্যক্রমে সংযোজিত হলো মানবসভ্যতার ইতিহাস।প্রস্তরযুগীয় গুহাচিত্রের প্রাপ্তিস্থান হিসাবে সুপরিচিত মধ্যভারতের ভীমবেটকার সাথেই পেলাম আর একটি নাম – বিহারের নওয়াদা জেলার কৈমুর। প্রবল আনন্দ সহকারে প্রথমেই ভাঙ্গলো দ্বিতীয় ভুল ধারণাটি।আনন্দের কারণ,নওয়াদা জেলা দিয়েই আমার নিয়মিত যাতায়াত ভাইয়ের বাড়িতে। অর্থাৎ,ভীমবেটকার সহোদর এখন আমার নাগালের মধ্যেই।আমার প্রাগৈতিহাসিক হওয়া আর আটকায় কে ! তখনই সময় এলো প্রথম ভুল ধারণাটি ভাঙ্গার। আসলে ওইসময় আমি খুব একটা ‘টেকস্যাভি’ ছিলাম না। মোবাইলে ‘নেটসার্চ’ বা ‘জিপিএস’ ব্যবহার করতাম না বললেই চলে।তো, ২০১১ সাল পর্যন্ত পুরো নওয়াদা জেলা চষে ফেললাম, এমনকি, হাইওয়ে পেট্রোলপুলিশ থেকে নওয়াদা থানা অবধি আমায় দাগী আসামীর মতো চিনে ফেলল।একটা পাহাড়, যাতে জঙ্গল আছে, গুহা আছে, গুহায় ছবিও আছে, আর আছে আদিবাসী – এমন বিচিত্র বর্ণনা শুনেও জেলার কেউ কোনো সন্ধান দিতে পারলো না।মাঝখান থেকে,পেট্রোলিংয়ের কথা মতো,আদিবাসী অধ্যুষিত জঙ্গুলে পাহাড়ের সন্ধানে খুঁজে ফেললাম অপরূপ কাকোলাত ফলস্।শেষমেষ জেলাশাসকের কাছে দরবার করার সিদ্ধান্তই নিতে যাচ্ছিলাম। বাঁচিয়ে দিল আমার ভাইয়ের গ্রামের এক মুরুব্বি। আমার সমস্যার কথা জেনে এক সন্ধ্যায় গ্রামে রীতিমতো মিটিং করে জানা গেল,কৈমুর রোহতাস জেলার কাছে।সাসারাম- ভাবুয়ার দিকে।যা কিনা নওয়াদার সম্পূর্ণ উল্টোদিকে। অর্থাৎ, ছাপার অক্ষরকে অন্ধবৎ বিশ্বাস করা পাপ – প্রমাণিত হলো।
২০১৬ সালে আমার অল-ইন-ওয়ান মনোজ ভাইয়া ও তার তিন গাঁওয়ালার সাথে কলকাতা থেকে রওনা হলাম কৈমুরের উদ্দেশ্যে।সেবার জিপিএসের সাহায্য নিয়েছিলাম। কিন্তু বিশেষ লাভ হলোনা। নেটওয়ার্কই নেই।সাসারাম পার করে স্থানীয় লোকজনদের জিজ্ঞাসাবাদ করে পৌঁছে গেলাম পাতেসরের আগের গ্রাম মুকবা দিবানেতে।যদিও গ্রামের নামটা তখনো অজানা।দুপাশে পাহাড়ের মাথায় অদ্ভুতদর্শন গুহার চাতাল দেখে মনে হলো আমার গন্তব্যে পৌঁছে গেছি। রাস্তার মোড়ে একটা ঝুপড়ি চায়ের দোকান। চায়ের গ্লাস হাতে ধরিয়ে দিয়ে বৃদ্ধ দোকানি জানালেন, আশেপাশের সবক’টা গুহাতেই দেবতা,অপদেবতা দুজনেরই আঁকা ছবি আছে। মহা উৎসাহে ওপরে উঠার তোড়জোড় করলাম।সঙ্গী,আমার ভাই মনোজ, তার গ্রামের মুরুব্বি অমরনাথ ও অপর গাঁওয়ালা ভাই মঞ্ছেলাল।
আমাদের গাড়িটা দাঁড় করেছিলাম একটি মাটির বাড়ির সামনে। গৃহকর্ত্রী পরম সমাদরে বসতে বললেন। শহুরে সন্দিগ্ধ মন চমকে গেছিল অযাচিত, অনাস্বাদিত আতিথেয়তায়, যখন আশাদেবী দুপুরের খাওয়া-দাওয়ার জন্য আন্তরিক পীড়াপীড়ি করলেন। পাহাড় ঘুরে এসে চা খাবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে চারজনে এগোলাম। ঘন কাঁটাঝোপ।পাথরের ওপর দিয়ে টাল সামলে, গা বাঁচিয়ে ওপরে উঠছি। সামান্য উঠতেই ছোট পাথরের পালা শেষ। বিশালাকার, মসৃণ পাথর বেয়ে চূড়ায় ওঠা রীতিমতো দুরূহ, প্রায় অসম্ভব। অমরনাথ আর মঞ্ছেলাল রণে ভঙ্গ দিয়ে নিচে আশাদেবীর ঘরে চলে গেল। আমি অদম্য। বহু প্রতীক্ষিত গন্তব্যে আমায় পৌঁছতেই হবে।
আধাআধি ওঠার পর হতাশ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়তে বাধ্য হলাম। যে পাথরের চূড়ায় আকাঙ্ক্ষিত গুহা, সেটা এতটাই বিরাট আর মসৃণ, দড়ি বা কোনো সরঞ্জাম ছাড়া সেটায় ওঠা অসম্ভব।মনোজ সমানে নিরুৎসাহিত করে চলেছে, “উতর চলিয়ে। কিতনা উঁচাই চঢ় গ্যয়ে, দেখিয়ে ইকবার।অগর কঁহি ফিসল্ গ্যয়ে, তো নিশান তক্ নহি মিলেগি। মেরা তো হাতকঢ়ি লগ্ জায়েগা।” অমৃতং বালভাষিতং(দুই অর্থেই) মনোভাব নিয়ে উপায় ভাবতে লাগলাম। আমার মরীয়া চেষ্টা দেখে বোধহয় ‘দেবতা’ ও ‘অপদেবতা’ দুজনেরই দয়া হলো। হঠাৎই ওই দুর্গম পাথরের মাথা থেকে নেমে এলো দুটি তরুন। স্থানীয় বাসিন্দা তারা। জানালো, ছোট্ট থেকেই এইসব পাহাড়ে চড়ায় তারা অভ্যস্ত। ওরা ওপরে উঠে আমাকে টেনে তুলতে পারবে। মনোজের রক্তচক্ষু,গজগজানি তুচ্ছ করে রাজি হয়ে গেলাম।কিন্তু বাদ সাধল বাঙ্গালী রমণীর উচ্চতা – হাত ও পা, দুটোর দৈর্ঘ্যই বুঝিয়ে দিল, আজন্ম কমপ্ল্যান খেয়েও আমি বাড়তে পারিনি। আবারও মুস্কিল আসান ওরাই।
-“ম্যাডাম, আপ সিঁড়িয়া চঢ় সকেঙ্গে? ইস পথ্থর সে উস পথ্থর তক সিঁড়ি লগা দেঙ্গে তব্।”
-“সিঁড়িয়া কঁহা মিলেগা?” মনোজের দিকে না তাকিয়েই প্রশ্ন করলাম।
-” নিচে সে লায়েঙ্গে।”
-” নহি, নহি। ইয়ে possible নহি হ্যয়। আপ নিচে যাওগে, ফির সিঁড়িয়া লে কর উপ্পর চঢ়োগে?”
-“কোই দিক্কত নহি হ্যায়,ম্যাডাম। হমে কোই তকলিফ নহি হোগা।লেকিন বিশ মিনট টেইম দেনা হোগা।”
রাজি হলাম সানন্দে। পাথরের চাতালে পা ছড়িয়ে বসলাম।ওরা দৌড় দিল নিচে। ওপর থেকে দেখলাম, অমর ওদের আটকে কথা বলছে।আশাদেবীও এসে কিসব বললেন। খানিক পরে ওরা পথের বাঁকে হারিয়ে গেল।সামনে পুরো গ্রাম, সবুজ ক্ষেত, টলটলে পুকুর – এক অপূর্ব ল্যান্ডস্কেপ যেন। প্রায় আধঘন্টা বাদে ওরা হাঁফাতে হাঁফাতে মই নিয়ে ওপরে উঠলো।
-“ম্যাডাম, নিচে আপকি জো ভাই বৈঠে হ্যঁয়, বো ক্যয়া পুলিশবালা হ্যঁয়?”
-“কিঁউ?”
-“বহোত পুছতাছ কর রহে থে। হমলোগ কৌন হ্যঁয়,পাহাড়ি পর ক্যয়া করনে কে লিয়ে চঢ়ে থে, ক্যয়সে চঢ়ে, আপ ক্যয়া কর রহে হ্যঁয়, সিঁড়িয়া কিঁউ চাহিয়ে, ইয়েহি সব।”
-” বো তো ইয়েভি কহা কে অগর আপকা কুছ হো জাএ তো পুরা গাঁওকো জেল ভেজেঙ্গে,” দ্বিতীয় তরুনের সরল কিন্তু ভীত প্রশ্ন ধেয়ে এলো,”আপ কৌন হ্যঁয় ম্যাডাম?”
খাইসে।প্রোটেকশনের আতিশায্যে না ইতিহাসের দিদিমণির ইতিহাস লেখা বানচাল হয়ে যায়। দেঁতো হেসে বললাম, ওটা ভাইদের বিধিসম্মত সতর্কতা মাত্র। ভয়ের কিচ্ছুটি নেই।মই লাগিয়ে পাহাড়চূড়ায় পৌঁছতেই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো, চোখের সামনে উদ্ভাসিত নব্য-প্রস্তর যুগ।
পাথরের গায়ে লাল রঙে অজস্র চিত্র। এক পুরুষের চিত্র – আকৃতির বিশালতায় মনে হয় গোষ্ঠীপতি, ময়ুর, হাতি, অস্ত্র,নৌকা এবং সূর্য। কিন্তু কি ভীষন অনাদৃত! এমন এক অমূল্য সম্পদ লোকচক্ষুর অন্তরালে, অজানার অন্ধকারে, প্রত্নতত্ত্ববিভাগের অবহেলায় ক্রমবিলীয়মান। বর্ষার জলে মুছে গিয়ে,নিয়মিত পাথর কেটে স্থানীয় গৃহনির্মানে ব্যবহারে ধ্বংস হচ্ছে মানবসভ্যতার আঁতুর।আশাদেবীর ঘরেই দেখেছিলাম বেশ কিছু পাথরের স্ল্যাব দিয়ে চাতাল করা, যাতে ওই লাল রঙের অস্তিত্ব প্রমাণ করে, সেগুলিতেও কোনো না কোনো চিত্রের নিদর্শন ছিল।একই ধরনের চিত্রাঙ্কন দেখেছি এখানকার মাটির ঘরগুলিতেও। আসলে এই বিষয়টি Ethno-rock art study- র অন্তর্ভুক্ত – যার প্রধান প্রতিপাদ্য হলো নব্যপ্রস্তর যুগীয় জীবনশৈলী আজও এই অঞ্চলের আদিবাসী তথা দলিত সম্প্রদায়ের মধ্যে বিদ্যমান। এব্যপারে পরের যাত্রায় বিস্তারিত বলব। আপাততঃ দমচাপা, ভারি মন নিয়ে নেমে এলাম। অসহায়তার অনুভূতি আচ্ছন্ন করে রেখেছে। কিছুই কি করতে পারবোনা এই সম্পদকে রক্ষা করার জন্য? সভ্যতার প্রসবাগারের কি কোনো ঋণ বর্তায় না উত্তরসূরীদের ওপর?
এবার ফেরার পালা। কারণ, থাকার কোনো বন্দোবস্ত নেই এই অঞ্চলে। নিকটবর্তী হোটেল পাওয়া যাবে প্রায় পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরে,ভাবুয়ায়। আমার সঙ্গীরাও জায়গাটুকু খুঁজে পেয়েই সন্তুষ্ট। আর কালক্ষেপ করতে তারা নারাজ। তাদের কথায়, এখানে তো দেখার কিছুই নেই। তাহলে আর থেকে লাভ কি? আশাদেবী কথা দিলেন, পরেরবার এলে তাঁর ঘরেই আশ্রয় জুটবে। খুদকুঁড়ো যা জোটে, তাই দিয়েই অতিথি সৎকার করবেন।
আমি আবার আসব কৈমুর। পিতৃপুরুষের ঋণ শুধতে না পারি, অন্তত স্বীকার করতে আসব। এবার একা আসব, পিছুটান ছাড়া। যাতে তোমাদের কথা শুনতে পারি, অনুভব করতে পারি। আপাতত বিদায়।
‘দ্বিতীয় যাত্রা’ দু’এক দিনের মধ্যেই

কাজরী মুখোপাধ্যায়

চাক‌রির খবর

ভ্রমণ

হেঁসেল

    জানা অজানা

    সাহিত্য / কবিতা

    সম্পাদকীয়


    ফেসবুক আপডেট